আলেম সমাজের রাজনীতি
বাংলাদেশে আলেম সমাজ ও আওয়ামীলীগের সম্পর্ক কিছু ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিছুদিন আগে একজন পুলিশ অফিসার বলছিলেন, তারা রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক আলেমদের মধ্যে পার্থক্য করতে চান। গতকাল মামুনুল হককে যে পুলিশ অফিসার গ্রেফতার করেছিল, মাস কয়েক আগে সেই একই পুলিশ অফিসার মামুনুল হকের পরিচালিত ওলামা সমাবেশে উপস্থিত হয়ে আলেমদের সাথে সরকারের সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন, রিসোর্টকাণ্ডে যে আওয়ামীলীগ নেতারা মামুনুল হককে লাঞ্চিত করেছিল, তাদের একজন মাস কয়েক আগে মামুনুল হকের আপ্যায়নে উপস্থিত ছিল।
অস্পষ্টতা শুধু আওয়ামীলীগের তরফেই নয়, আলেমদের তরফেও আছে অনেক। আলেমরা অরাজনৈতিক আন্দোলন করতে চান, আওয়ামীলীগ দুইশো বছর ক্ষমতায় থাকলেও তাদের আপত্তি নেই। মুশকিল হচ্ছে, তারা যে আন্দোলন করছেন, তার ভাষা ও প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ধর্ম কখনোই থাকতে পারে না রাজনীতিমুক্ত । বস্তুত রাষ্ট্রের সাথে আলেম সমাজের সম্পর্ক কেমন হবে, এই প্রশ্ন ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। মাওলানা মওদুদি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এই অভিযোগ তুলেই, তার মতে পাকিস্তানে ইসলামি আইন অসম্ভব ; এর ভিত্তিতে তিনি শাব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে প্রণীত অবজেক্টিভ রেজুলেশনেরও বিরোধিতা করেন।
অনেকে মনে করবেন, আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে মাওলানা মওদুদি যে সুগঠিত তত্ত্ব পেশ করেছিলেন, সেটি মাওলানা উসমানি জানতেন না। এখানে বলে রাখা ভালো, ধর্মকে রাজনীতির প্রতিশব্দ ধরে মাওলানা মওদুদি যে তত্ত্ব প্রদান করেন, সেটি মুসলিম চিন্তার ইতিহাসে অত্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনা। মুসলিম চিন্তায় রাজনীতিকে ধর্মের বহির্ভূত মনে করার যে প্রবণতা চলমান ছিল শত শত বছর ধরে, মাওলানা মওদুদি সেই সিলসিলায় জোরালো প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হন। খেলাফত-মুলুকিয়াত এবং কুরআনের চার পরিভাষার মাধ্যমে মাওলানা মওদুদি চলমান মুসলিম ইতিহাস ও ধর্মের ভূমিকা নিয়ে মৌলিক সমালোচনা পেশ করেন। মুশকিল হচ্ছে, তাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সুগঠিত হলেও মওদুদির চিন্তায় ছিল বেশকিছু প্রান্তিকতা ; মুসলিম ইতিহাস, আলেমদের ভূমিকা ও ধর্ম-রাজনীতির সম্পর্কে তার প্রস্তাবনা ছিল অনেকটাই পবিত্রতাবাদী। খেলাফতে রাশেদার পরে এমন পবিত্র সম্পর্ক কখনোই দেখা যায়নি।
শাব্বির আহমদ উসমানিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধর্মীয় তাত্ত্বিক হিসেবে ধরা হয়। তিনি মনে করতেন, ধর্মকে রাজনীতির প্রতিশব্দ মনে করার অসুবিধা অনেক। নিছক আলেম সমাজের পক্ষে ‘স্বতন্ত্র রাজনীতি’ করা সম্ভব নয়। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয়েই উসমানী পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন, তাত্ত্বিক বৈধতা পেশ করেন। তিনি এই সম্পর্ককে তুলনা করেন হজ্বের জাহাজের সাথে ; তৎকালে উপমহাদেশ থেকে মুসলমানরা ইংরেজ পরিচালিত জাহাজে জেদ্দায় যেতেন। বন্দরেে নামার আগে পাথুরে ডুবোপাহাড় ছিল অনেক। তাই কিছুদূর আগে থেকেই জাহাজের দায়িত্ব নিতেন স্থানীয় নাবিকরা। উসমানীর মতে আলেম সমাজের রাষ্ট্রীয় ভূমিকা হবে জেদ্দার স্থানীয় নাবিকদের মতো। তারা প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে জড়াবেন, প্রয়োজনীয় ভূমিকায় সীমিত থাকবেন। বস্তুত এই তত্ত্বকে বলা যায় আশরাফ আলী থানবির চিন্তার ধারাবাহিকতা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও এই অস্পষ্টতা কাটেনি। শেখ মুজিব অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একটা বিশেষ ঘটনা তুলে ধরেন। এক নির্বাচনে শামসুল হক ফরিদপুরী মুজিবের বিরোধীপ্রার্থীকে সমর্থন করেন। মুজিব ব্যক্তিগতভাবে ফরিদপুরীকে পছন্দ করলেও তার রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতাকে ভালো চোখে দেখেননি। এখানে বলে রাখা ভালো, ফরিদপুরী ছিলেন থানবির বিশেষ ছাত্রদের একজন। মনে করিয়ে দেই, থানবি রাজনীতি ও ধার্মিকতায় বিচ্ছিন্নতা-অখণ্ডতা নয়, স্বতন্ত্রতার প্রবক্তা ছিলেন। নির্বাচনে ফরিদপুরির পক্ষের প্রার্থী পরাজিত হন। শেখ মুজিবের মূল্যায়ন ছিল, আলেমদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই ভালো। বস্তুত এভাবে থানবি ও উসমানীর চিন্তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রযোজ্য হবে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। এই অস্পষ্টতার প্রেক্ষিতেই আওয়ামীলীগ বনাম জামায়াতের দ্বৈরথ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। অর্থাৎ ধর্মমুক্ত রাজনীতি বনাম রাজনীতিসর্বস্ব ধর্ম।
মুক্তিযুদ্ধের আগে মাওলানা মওদুদি সমাবেশে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসেন। আওয়ামীলীগের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। শেখ মুজিব নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকার মাদরাসাগুলোতে ফোন করে সতর্ক করেন, ছাত্ররা যাতে সমাবেশের দিন শহরের প্রাণকেন্দ্রে না যায় সে বিষয়ে পরিচালকদের অবহিত করেন। পল্টনে পাল্টাপাল্টি সমাবেশে অনেক রক্ত ঝরে। চিন্তাগত বিরোধের প্রেক্ষিতে আলেমদের সাথে জামায়াতের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে আবদুল মালেক নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামায়াতের ছাত্রনেতা মারা যান, সমাবেশে যোগ দেবার কারণে ঢাকার এক অভিজাত মাদরাসা থেকে একজন শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়, তবে আবার একইমাদরাসার একজন মুরুব্বি উস্তাজ আবদুল মালেকের জানাজার নামাজ পড়ান।
মুক্তিযুদ্ধকে জামায়াতের পক্ষ থেকে গণ্য করা হয় ইসলাম বনাম ইসলামহীনতার লড়াই, উল্লেখযোগ্য আলেম সমাজ একে গৃহযুদ্ধ হিসেবে দেখেন, আলেমদের জমিয়ত অংশ মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী মনে করে আওয়ামীলীগের প্রতি নীতিগত সমর্থন প্রদান করেন। মনে রাখা ভালো, আলেমদের এই অংশের সাথে জামায়াতের বিরোধ অত্যন্ত প্রবল। ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ ও নূর হুসাইন কাসেমি এই ধারার ধারাবাহিকতা। আল্লামা আহমদ শফিও ছিলেন এই ধারায় প্রভাবিত। তার লেখাজোখা এই দাবীর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই ধারায় ধর্মকে রাজনীতি থেকে স্বতন্ত্র করে দেখার প্রবণতা চালু আছে। চালু আছে জামায়াতের রাজনৈতিক চিন্তার স্পষ্ট বিরোধিতাও।
অপরপক্ষে আশির দশকে হাফেজ্জি হুজুরের সিলসিলায় যে রাজনীতি বহমান, সেখানে ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এর মধ্যে মুফতি আমীনি আওয়ামীলীগ বিরোধিতায় প্রায় জামায়াতের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করেন, যদিও চিন্তাগতভাবে জামায়াতের রাজনীতি সর্বস্ব ধর্মের প্রচণ্ড সমালোচনাও করেন তার বিখ্যাত বই আদর্শ রাজনীতি-আদর্শ রাষ্ট্রনীতিতে। জীবদ্দশায় আমীনি আহমদ শফির রাজনৈতিক রক্ষণশীলতায় নাখোশিও জাহের করেন। তবে হাফেজ্জি হুজুরের প্রধান তিন রাজনৈতিক শাগরেদের মৃত্যুর পরে নেতৃত্ব চলে আসে আহমদ শফির হাতে। তিনি তেরো সালের ভয়াবহ ঘটনার পরেও রাজনৈতিক উত্তাপ কমিয়ে আনেন। তবে তার প্রেক্ষিতে অনেকের কাছে ‘নতজানু’ / ‘দালাল’ উপাধিপ্রাপ্ত হন।
আহমদ শফির মৃত্যুতে আলেম সমাজে নতুন কালপর্ব শুরু হচ্ছে। মাস ছয়েকের মধ্যেই পাল্টে গেছে রাজনৈতিক মানচিত্র। প্রকাণ্ড স্বৈরাচারের মোকাবেলায় ধর্মের রাজনৈতিক ভূমিকা ঠিক কেমন হবে সেটি আবার অস্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশের আলেম সমাজ ও আওয়ামীলীগ কেউই এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নয়।