ইস্তেহাযার বিধান
ইস্তেহাযা অবস্থায় নামাজ ও রোজার হুকুম
ইসলামি শরিয়তে ইস্তেহাযা বলা হয়, হায়েজ ও নেফাসের নির্ধারিত দিনগুলোর অতিরিক্ত দিন কোনো নারীর যৌনাঙ্গ থেকে রক্ত বের হওয়া। কেউ কেউ বলেছেন, নারীদের যৌনাঙ্গ থেকে হায়েযের সর্বনিম্ন ৩ দিন থেকে কম অথবা অভ্যাসের অতিরিক্ত ১০ দিনের চেয়ে বেশি যে রক্তস্রাব হয় তাকে ইস্তেহাযা বা অসুস্থতার স্রাব বলে।
তেমনি ৯ বছর বয়সের আগে যদি রক্ত আসে বা গর্ভাবস্থায় যদি রক্ত আসে বা প্রসবকালীন সময়ে বাচ্চা প্রসবের আগে যে রক্ত বা পানি রেব হয় বা বাচ্চার অর্ধেকাংশ বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে রক্ত বের হয় বা নেফাসের সর্বোচ্চ সময় ৪০ দিন পার হওয়ার পরও রক্ত আসতে থাকলে সেই রক্তকেও ইস্তেহাযা বলে গণ্য করা হয়। (সূত্র: ফাতওয়ায়ে আলমগীরী)
ইস্তেহাযার হুকুম বা বিধান : ইস্তেহাযার হুকুম আর পবিত্রতার হুকুম একই। যে নারী ইস্তেহাযাগ্রস্ত তাকে মুস্তাহাযাহ মাজুরও বলা হয়। মুস্তাহাযাহ নারী এবং পবিত্র নারীর মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই।
মুস্তাহাযা নারীর নামাজ প্রসঙ্গ : (১) পবিত্র নারীর ওপর যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ, মুস্তাহাযা নারীর ওপরও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। তবে মুস্তাহাযা নারীর জন্য প্রতি নামাজে ওযু করা ওয়াজিব। প্রমাণ হচ্ছে, ফাতেমা বিনতে আবী হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূল সা.-কে প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার অবিরাম রক্তস্রাব হচ্ছে যার কারণে আমি পবিত্র হতে পারছি না। এমতাবস্থায় আমি কি নামাজ ছেড়ে দেব? উত্তরে নবী সা. বললেন, না, এটি রগ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত। তবে হ্যাঁ, সাধারণত: অন্যান্য মাসে যতদিন তুমি ঋতুবতী থাকতে ততদিন নামাজ থেকে বিরত থাক তারপর গোসল করে নামাজ আদায় কর। (বুখারী)
(২) মুস্তাহাযাহ নারী যখন ওজু করার ইচ্ছা করবে তখন রক্তের দাগ ধৌত করে যোনীতে তুলা দিয়ে পট্টি বেঁধে নিবে, যেন উক্ত তুলা রক্তটাকে আঁকড়ে ধরে। এ প্রসঙ্গে নবী সা. হামনাহ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে লজ্জাস্থানে কুরসুফ তথা নেকড়া বা তুলা ব্যবহার করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা নেকড়া বা তুলা রক্তটাকে টেনে নিবে। জবাবে হামনাহ রা. বললেন, আমার প্রবাহমান রক্তের পরিমাণ তদপেক্ষাও বেশি। অত:পর রাসূল সা. বললেন, তাহলে তুমি লজ্জাস্থানে কাপড় ব্যবহার কর। হামনাহ রা. বললেন, প্রবাহমান রক্তের পরিমাণ তার চেয়ে আরো বেশি। এরপর রাসূল সা. হুকুম দিলেন যে, তুমি তাহলে যোনীর মুখে লাগাম বেঁধে নাও।’
এ হাদীসের ব্যাখ্যা : রক্তের দাগ-চিহ্ন পরিষ্কার করে যোনীতে তুলা দিয়ে পট্টি বাঁধার পরেও যদি রক্ত প্রবাহিত হয় তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম সা. এর হাদীস রয়েছে যে তিনি ফাতেমা বিনতে আবী হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যে কয়দিন তুমি ঋতুস্রাবে আক্রান্ত থাকবে সে কয়দিন নামাজ থেকে বিরত থাক। তারপর গোসল করে প্রতি নামাজের জন্য ওজু কর এবং নামাজ আদায় কর, যদিও রক্ত প্রবাহিত হয়ে চাটাই-এর ওপর পড়ে তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। (আহমদ ও ইবনে মাজাহ)
(৩) মুস্তাহাযার সহবাস প্রসঙ্গ : সহবাস বর্জন করলে যদি কোনো বৈরিতার আশঙ্কা থাকে তাহলে ওলামায়ে কেরামের মাঝে এর বৈধতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে সঠিক অভিমত হচ্ছে, ইস্তেহাযার অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম জায়েয। কেননা নবী করীম সা. এর যুগে দশ অথবা ততোধিক সংখ্যক মহিলা ইস্তেহাযাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অথচ আল্লাহ তাআলা ও তাঁর প্রিয় রাসূল সা. তাদের সঙ্গে সহবাস করতে নিষেধ করেননি। অথচ পবিত্র কোরআন মজীদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা হায়েযের অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাক।’ (সূরা আল-বাকারাহ: ২২২)
এ আয়াত প্রমাণ করে যে হায়েয ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়। দ্বিতীয়ত: মুস্তাহাযাহ নারীর নামাজ যেহেতু জায়েয সেহেতু সঙ্গমও জায়েয। কেননা সঙ্গম তো নামাজের চেয়ে আরো সহজ। মুস্তাহাযাহ নারীর সঙ্গে সহবাস করাটাকে ঋতুবতী নারীর সঙ্গে সহবাস করার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করলে চলবে না। কারণ এ দুটো কখনো এক হতে পারে না। এমনকি মুস্তাহাযাহ নারীর সঙ্গে সঙ্গম করাকে যারা হারাম মনে করেন তাদের কাছেও দুটো এক নয়। সুতরাং উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকায় একটাকে অপরটার ওপর কিয়াস করা শুদ্ধ হবে না।
মুস্তাহাযা বা অনবরত রক্ত প্রবাহিত হয় এমন নারীর অবস্থা তিন প্রকার : (১) ইস্তেহাযাহ অর্থাৎ অনবরত রক্ত প্রবাহ আরম্ভ হওয়ার আগে তার প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋতুস্রাবের অভ্যাস ছিল। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে পূর্ব নির্ধারিত সময় পর্যন্ত প্রবাহমান রক্তকে হায়েয হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর ওপর হায়েযের বিধি-বিধান কার্যকরী হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পরের রক্তস্রাবকে ইস্তেহাযাহ গণ্য করে তার নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। যেমন, একজন নারীর প্রতি মাসের প্রথম দিকে ছয় দিন করে রক্তস্রাব হয়ে থাকে। এখন হঠাৎ করে দেখা গেল যে, ওই নারীর অবিরাম রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তাহলে তখন প্রতি মাসের প্রথম ছয় দিনে প্রবাহিত রক্তকে হায়েয হিসেবে গণ্য করে বাকীটাকে ইস্তেহাযাহ হিসেবে ধরে নিতে হবে।
কেননা আয়েশা রা. এর হাদীস দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়। সহীহ মুসলিমে আছে, ‘নবী করীম সা. উম্মে হাবীবা বিনতে জাহ্শ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ওই পরিমাণ সময় অপেক্ষা কর যে পরিমাণ সময় সাধারণত: ঋতুস্রাবে আক্রান্ত থাক। অত:পর গোসল করে নামাজ আদায় কর।’ এ থেকে বুঝা যায়, মুস্তাহাযাহ অর্থাৎ অবিরাম রক্তস্রাব হয় এমন নারী ওই পরিমাণ সময় অপেক্ষা করবে এবং নামাজ থেকে বিরত থাকবে যে পরিমাণ সময় সে সাধারণত: ঋতুস্রাবে আক্রান্ত থাকত। তারপর গোসল করে নামাজ আদায় করতে থাকবে এবং রক্তের কারণে নামাজ আদায়ে মনে কোনো রকম দ্বিধা রাখবে না।
(২) ইস্তেহাযাহ আরম্ভ হওয়ার আগে আক্রান্ত নারীর ঋতুস্রাবের কোনো নির্দিষ্ট সময়-সীমা নেই। অর্থাৎ জীবনে এটাই তার প্রথম রক্তস্রাব। এমতাবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত প্রবাহিত রক্তে কালো বর্ণ অথবা গাঢ়তা কিংবা কোনো গন্ধ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত হায়েযের বিধি-বিধান কার্যকরী হবে। অন্যথায় ইস্তেহাযাহ হিসেবে গণ্য করে তার নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। যেমন, একজন নারী জীবনে প্রথম লজ্জাস্থানে রক্ত দেখলো এবং সে রক্তকে দশদিন পর্যন্ত কালো দেখেছে এবং মাসের অবশিষ্ট দিনগুরোতে লাল দেখেছে। অথবা দশদিন পর্যন্ত গাঢ় ও ঘন ছিল এবং মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে পাতলা ছিল। অথবা দশদিন পর্যন্ত তার মধ্যে গন্ধ ছিল এবং তার পরে কোনো গন্ধই থাকে নাই, তাহলে প্রথম দৃষ্টান্তে প্রমাহমান রক্ত কালো বর্ণ থাকা পর্যন্ত, দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে গাঢ়তা থাকা পর্যন্ত এবং তৃতীয় দৃষ্টান্তে গন্ধ থাকা পর্যন্ত হায়েয হিসেবে গণ্য হবে এবং এর পর হতে ইস্তেহাযাহ হিসেবে গণ্য হবে।
কারণ হাদীসে বর্ণিত আছে নবী করীম সা. ফাতেমা বিনতে আবী হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছেন: যখন হায়েযের রক্ত দেখা দিবে তখন তা কালো বর্ণের হবে যা চেনা যায়। সুতরাং কালো বর্ণের রক্ত দেখা দিলে নামাজ থেকে বিরত থাক। আর কালো ছাড়া অন্য কোনো বর্ণ দেখা দিলে ওজু করে নামাজ আদায় কর। কেননা তা রগ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত।
এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ ও ইমাম নাসায়ী বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে হিব্বান ও হাকেম বিশুদ্ধ বলে মতামত দিয়েছেন। প্রকাশ থাকে যে, উক্ত হাদীসের সনদ ও মূল উদ্ধৃতিতে কিছু সমস্যা থাকলেও ওলামায়ে কেরাম এর ওপর আমল করেছেন। এবং অধিকাংশ নারী জাতির নিয়মিত অভ্যাসের দিকে লক্ষ্য করে হাদীসখানার ওপর আমল করাই উত্তম।
(৩) মুস্তাহাযাহ নারীর পূর্বে ঋতুস্রাবের না কোনো নির্দিষ্ট সময়-সীমা আছে না ইস্তেহাযাহ ও হায়েযের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী কোনো চিহ্ন আছে। অর্থাৎ জীবনে এটাই তার প্রথম রক্তস্রাব এবং রক্ত একাধারে অবিরাম বের হচ্ছে। প্রবাহমান রক্ত পুরোটাই এক ধরনের অথবা বিভিন্ন রকমের যেটাকে হায়েয হিসেবে গণ্য করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় অধিকাংশ নারীর ঋতুস্রাবের সময়-সীমা অনুযায়ী আমল করতে হবে। অর্থাৎ অবিরাম রক্তস্রারাব আরম্ভ হওয়ার পর থেকে প্রতি মাসে ছয় অথবা সাত দিন হায়েযের নিয়ম-নীতি কার্যকরী হবে। তারপর ইস্তেহাযার হুকুম পালন করতে হবে। যেমন, একজন মেয়ের মাসের ৫ তারিখে রক্ত প্রবাহ আরম্ভ হয়েছে এবং জীবনে এটাই তার প্রথম। রক্ত বিরতহীনভাবে বের হচ্ছে এতে হায়েযের কোনো চিহ্ন নেই। রং ও গন্ধ ইত্যাদি দিয়ে পার্থক্য করারও কোনো সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় প্রতি মাসের ৫ তারিখ থেকে ছয় অথবা সাত দিন হায়েযের হুকুম পালন করতে হবে। কারণ হামনাহ বিনতে জাহ্শ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এ ব্যাপারে প্রিয় নবী সা. এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হামনাহ বিনতে জাহ্শ রাদিয়াল্লাহু আনহা এ ব্যাপারে প্রিয় নবী সা. এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার তো অনেক দীর্ঘ সময় ধরে খুব বেশি পরিমাণে রক্তস্রাব হচ্ছে। এ অবস্থায় আপনার মতামত কি? এটা তো আমার নামাজ ও রোজা আদায়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূল সা. বললেন, আমি তোমাকে যোনীতে তুলা ব্যবহার করার পর পরামর্শ দিচ্ছি, তুলা রক্ত টেনে নিবে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন যে, আমার প্রবাহিত রক্ত তার চেয়েও বেশি। তখন নবী সা. ইরশাদ করলেন, এটা শয়তানের একটা খোঁচা মাত্র। আপাতত: তুমি ছয় অথবা সাত দিন হায়েযের হুকুম পালন করে চল। তারপর ভালো করে গোসল কর।
যখন তুমি মনে করবে যে, তুমি পবিত্রতা অর্জন করেছ তখন ২৪ দিন অথবা ২৩ দিন নামাজ ও রোজা আদায় করতে থাক। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ, ইমাম আবু দাউদ সহীহ বলেছেন এবং ইমাম বুখারী থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি হাসান বলেছেন। (সূত্র: আহকামে যিন্দেগী ও বেহেশতি জেওর)