তাহাফফুজে মাদারিসে কওমিয়া’র ১১ দফা আহ্বান

কওমি মাদরাসার আদর্শ ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, মাদরাসা খুলে দেওয়া এবং অমূলক হয়রানী বন্ধের দাবীতে আয়োজিত তাহাফফুজে মাদারিসে কওমিয়া বাংলাদেশের এক পরামর্শ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ (২৪ এপ্রিল) শনিবার সকাল ১১ টায় রাজধানীর তেজগাঁও রেলওয়ে জামিয়ায় সারাদেশের মুহতামিমদের এ পরামর্শ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এতে তাহাফফুজে মাদারিসে কওমিয়া’র ১১ দফা আহ্বান জানানো হয়।
সংগঠনটির আহবায়ক মাওলানা ড. মুশতাক আহমদে সভাপতিত্বে সংগঠনটির সদস্য সচিব মুফতি মুহাম্মদ আলীর পরিচালনায় প্রোগ্রামের সূচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের যুগ্ম সদস্য সচিব মাওলানা মুজিবুর রহমান ফয়জী। মুহতামিম সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, জামিউল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবুল বাশার নোমানী, ঢাকার সেগুনবাগিচা মসজিদের খতীব মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সোবহানী, খুলনার মাওলানা এমদাদুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা আব্দুল বাতেন শরিয়তপুর, মাওলানা আব্দুল কাদের বরিশাল, মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক কাসেমী, মাওলানা আব্দুল হক কাউসারী, মাওলানা আবুল কালাম, মাওলানা খলিলুর রহমান, মাওলানা নূরুল হুদা ফয়েজী, বাহাদুরপুরের পীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ হাসান, মাওলানা জহির বিন ইসমাইলসহ সারাদেশের বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিম।
সংগঠনের আহবায়ক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, আমরা আগেও কয়েকবার এককভাবে চেষ্টা করেছি। সরকার আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু ভাইয়ের অযাচিত বক্তব্যের কারণে সরকার মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। মাদরাসায় ছাত্র ভর্তি নেয়ার সময় কোনো রকমের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকবো না মর্মে স্বাক্ষর করলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে আমরা ছাত্রদের অংশ নিতে বাধ্য করাই। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের আকাবিররা রাজনীতির জন্য শুধু ছাত্রের উপর নির্ভর ছিলেন না। তাই পুনরায় আমাদের সবার সহযোগিতায় মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার জন্য চেষ্টা করছি। আপনাদের সবার সহযোগিতা কামনা করছি।
সংগঠনের যুগ্ম আহবায়ক মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ বলেন, আমাদের মাদরাসাগুলো ঐতিহ্যের ধারায় লালিত। আমরা কখনো সরকারবিরোধী কোনো কার্যক্রমের সাথে কখনোই জড়িত নই। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অযাচিত বক্তব্যের কারণে আমাদের মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া কোনোভাবেই আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আপনাদের সমর্থন দোয়া কামনা করছি।
এছাড়া এতে উপস্থিত ছিলেন, জামিয়া দারুল উলুম বনশ্রী মাদরাসার মুহতামিম ও সংগঠনটির যুগ্ম আহবায়ক, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মাওলানা হেলাল উদ্দীন, ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন, মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল কাদের কাসেমী, মাওলানা শেখ আব্দুর রাজ্জাক কাসেমী, মাওলানা শহিদুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা আবু বকর বরিশাল, মুফতি কামরুজ্জামান ফরিদপুর, মাওলানা আব্দুল বাতেন, মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মামুন দাউদকান্দি, মাওলানা নূরুল্লাহ, মাওলানা মুজিবুরর রহমান সিলেট, মাওলানা সাইফুল্লাহ গাজী নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশের অনেক উলামায়ে কেরাম।
তাহাফফুজে মাদারিসে কওমিয়া’র আহ্বান-
১, তাহাফফুজে মাদারিসে কওমিয়া বাংলাদেশ- মনে করে যে, দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হােক না কেন, দীনী মাদরাসাসমহের তালীম, দরস, দো’আ, কালাম ইত্যাদি চলমান ও দেশের উপর আল্লাহ পাকের রহমত বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষত হিজখানা ও মকতব যেখানে কুরআন পাকের সরাসরি তালীম হয়ে থাকে সেটি কখনো না না র তালীম হয়ে থাকে সেটি কখনাে বন্ধ রাখা যায় না। কাজেই মকতব হিফজখানা খোলার আশু-ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরী।
২. কওমী মাদরাসাসমূহ হল সমাজে প্রতিষ্ঠিত দীন ইসলামের খালেছ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ইলম ও আমলের মারকায। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সর্বদা যেন উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়ে সর্বদা আল্লাহর দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেন সে জন্য এই মাদরাসাগুলাে কাজ করে থাকে। কওমী মাদ্রাসার মাধ্যমেই এদেশে ধর্মচর্চার কাজ প্রধানতভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। কাজেই রােজার পর যথানিয়মে কিতাবখানা খােলা এবং পরীক্ষা গ্রহণ ও ছাত্রভর্তির কার্যক্রম অব্যাহত থাকে সেজন্য আগে-ভাগেই উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী।
৩, কওমী আলেমদের কোন কোন আলিম বয়ান বক্তৃতার সময় নিজ জযবাকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে ব্যর্থ হন। অনেক সময় তাদের যবান থেকে অসাবধানে এমন কোন বাক্য কিংবা বক্তব্য বেরিয়ে আসে। যাকে শক্র দুশমনেরা সরকার বিরােধী, উগ্রবাদী বক্তব্য বলে প্রচারের সুযােগ হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। এ ধরণের অসাবধান বক্তব্য নি:সন্দেহে কওমী মাদরাসাসমূহের জন্য অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনবে। বিধায়। বয়ান বক্তৃতার অসাবধান বাক্য ও বক্তব্য পরিহার করা এবং বক্তৃতায় সাবধানতা অবলম্বন আশু প্রয়ােজন।
৪. এই অসাবধান বক্তৃতার ছুতা ধরে কোথাও কোথাও দেখা যায় কওমী আকীদার শত্রু দুশমনারা মাদরাসাগুলিকে নানা রকমের হয়রানীর মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মধ্যে আলিমদেরকে জড়িয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও স্থানীয় পূর্ব শত্রুতার প্রতিশােধ নেয়ার সুযােগ নিচ্ছে। পরিণামে মাদরাসাও মাদরাসার কর্তৃপক্ষ নানাভাবে হয়রানীর মুখােমুখি হচ্ছেন। এমতবস্থায় মাদরাসাগুলােকে উপরােক্ত নানাবিদ হয়রানীর মধ্যে পতিত হওয়া থেকে উদ্ধার করা আশু প্রয়ােজন।
৫. কওমী মাদরাসা আবহমানকাল থেকেই একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ পরিবেশ, গভীর পড়াশুনার জায়গা, ইলম ও আমলের সুন্দরতম মিলনক্ষেত্র, আদব ও আখলাকের সুন্দরতম আদর্শের ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত ছিল। এখানে ছাত্ররা কখনাে উস্তাদের সাথে বেআদবী করা, উস্তাদের নির্দেশের অমান্য করার চিন্তাও করত না। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় কোন কোন কওমী মাদরাসায় আদব আখলাকের এই শৃংখলা ভয়ানক ভাবে লঙ্গিত হতে চলেছে। পড়াশুনার চেয়ে মােবাইলের অপব্যবহার; মােবাইলের। মাধ্যমে নিজস্ব চিন্তাচেতনার প্রচার এমনকি মােবাইলের মাধ্যমে বাইরের কদর্য রীতিনীতির অনুসরণের দিনে ঝুকে যাচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই যে, কওমী মাদরাসাগুলি ক্রমে ক্রমে নিজ আদর্শ ঐতিহ্য ও আখলাক থেকে সরে যাচ্ছে তা এই মুহুর্তেই পতিরােধ করা আবশ্যক। নতুবা এটি কওমা মাদরাসাকে দ্রুত অস্তিতের। সংকটে ফেলে দিতে পারে।
৬. বওমী মাদরাসায় ছাত্রদের ভর্তির সময়ে বেশ কিছু ওয়াদা ও অঙ্গিকার নিয়ে ভর্তি করানাে হয়। শুরু থেকেই সকল কওমী মাদরাসায় এই নিয়ম চালু আছে। সেই সব ওয়াদা অঙ্গীকারের মধ্যে “মাদরাসার শিক্ষার্থী হিসাবে থাকা অবস্থায় কোন ধরণের । জানোতক দল গঠন করা, রাজনৈতিক দলের। সদস্য হওয়া উস্তাদের নেগরানী বিহীন কোন ধরণের মিটিং মিিছলে অংশ গ্রহণ করবে না” এর কথাটি। উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে দেখা যায় কোন কোন মাদরাসায় এই ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। আবার কোথাও উশৃংখলতা এতাে বেড়ে গিয়েছে যে, ছাত্ররা শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষ কিংবা। মুহতামিমের নির্দেশের কোনই তােয়াক্কা না করে ফেইজবুক কিংবা বাইরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুসরণে বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে যা কওমী মাদরাসার ঐতিহ্য ও আদর্শ পরিপন্থি, যা দ্রুত প্রতিরোধ জরুরী।
৭. কওমী মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থী ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের দারুল উলুম ‘দেওবন্দসহ মিশর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব গমনে গভীর প্রত্যাশী। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশ থেকে কওমী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা- এর ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক যােগ্যতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সম্মানজনকভাবে তারা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বহির্বিশ্বে গমনের সুযােগ পাচ্ছে না। অনেকে ভিন্ন পথে গমনের চেষ্টা করে পথিমধ্যে নানা রকমের জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। এমতবস্থায় কওমী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা প্রাপ্তির পথ তৈয়ার করে দেওয়া খুবই জরুরী।
৮.কওমী শিক্ষার্থীদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হল মাদ্রাসার শিক্ষাকতা। দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, ভাল ছাত্র হওয়ার মানে ভাল শিক্ষক নয়। একজন মানুষ মেধাবী ছাত্র হয়েও শিক্ষকতায় অদক্ষ হতে পারে। আবার একজন খুব মেধাবী না হয়েও শিক্ষক হিসাবে সুদক্ষ হতে পারে। তাই আমরা মনে করি যে, কওমী শিক্ষার্থীদের যারা শিক্ষকতা করতে আগ্রহী তাদের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের দ্রুত ব্যবস্থা করা জরুরী।
৯. কওমী শিক্ষার্থীদের আরেকটি বড় কর্মক্ষেত্র ধর্মীয় বিষয়ে ওয়াজ বয়ান ও বক্তৃতা প্রদান। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দেওবন্দী মাদরাসায় পড়াশােনা ও সার্টিফিকেট গ্রহণ সত্ত্বেও অনেকে ভিন্ন রকমের চিন্তা চেতনায় আক্রান্ত হয়ে যায়। অনেকে বিকৃত ও বিকার গ্রস্থ দর্শনের প্রচারে লিপ্ত হয় যা উম্মতকে এক জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমতবস্থায় আমরা মনে করি এই শিক্ষার্থীদের জন্য ফিল্ডে ওয়াজ মাহফিল কিংবা বয়ান বক্তৃতা কিভাবে। হতে পারে এবং কিভাবে হওয়া উচিত নয় এসবের প্রশিক্ষণের দ্রুত ব্যবস্থা করা।
১০. মাদরাসা কিংবা মাদরাসার শিক্ষকদের উপর অহেতুক কোন হয়রানী যেন হতে না এম এতদুদ্দেশ্যে শাষস্থানায় আলেমগণের একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা যায়। এই প্রতিনিধি দল সরকারের সাথে বসে অহেতুক হয়রানী বন্ধের ব্যবস্থা করবেন।
১১. মাদরাসাগুলোকে এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া জরুরী যে, কওমী মাদরাসাকে বাের্ড কর্তৃক প্রদত্তনীতিমালা এবং ভর্তির সময় যেসব ওয়াদা করা হয়েছে যেমন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত না হওয়া এর যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং যেসব ছাত্র বা শিক্ষক এই নীতি ভঙ্গ দ্ধে মাদরাসা কতৃপক্ষ শাস্তিমূলক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।