ধর্মীয় শিক্ষায় নারীদের পথ সুগম হোক
পৃথিবীর যা কিছু সৃষ্টি তার মূলে রয়েছে মানুষ। মানুষের সৃষ্টি না হলে আর কোনো কিছু অস্তিত্বে আসতো না। পৃথিবীর আদি মানুষ, আমাদের আদি পিতা হজরত আদম আঃ। আল্লাহ তায়ালা নিজ কুদরতে আদমকে সৃষ্টি করলেন। তাঁর প্রথম ঠিকানা ছিলো জান্নাত। জান্নাত সকল আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাসের স্থান। কিন্তু পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম আঃ জান্নাতে সকল আরাম-আয়েশের মাঝেও কিছু একটা শূণ্যতায় ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা আদম আঃ এর সেই শূন্যতাও রাখলেন না। তাঁরই বাম পাঁজর থেকে তৈরি করলেন মা হাওয়া আঃ কে। আদম আঃ এর নিঃসঙ্গতা দূর হলো। সুখ-শান্তির পূর্ণতা লাভ করলেন বাবা আদম আঃ।
আল্লাহ তায়ালার কুদরতি কারিশমায় একসময় সেই আদম-হাওয়া পৃথিবীর বুকে আগমন করলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের থেকে প্রজন্ম তৈরি হতে শুরু করলো। পৃথিবীতে মানব জাতির বিস্তার ঘটলো ব্যাপক আকারে। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হলো,শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা পুরুষ জাতির পাশাপাশি নারী জাতিকে আবশ্যক সৃষ্টি হিসেবে নির্ধারণ করলেন। সকল ক্ষেত্রে নারীকে বানালেন সহযাত্রী, সহযোগী, সহায়ক শক্তি।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন পৃথিবীতে আগমন করলেন তখনকার মক্কার অবস্থা সকলের জানা। জাহিলিয়াতের যুগ বলা হয় ঐ সময়টাকে। এর অন্যতম কারণ ছিলো, ঐ সময় পুরুষেরা নারী জাতিকে এতোটাই ঘৃণার চোখে দেখতো যে, নারীদেরকে মানুষের স্বীকৃতি দিতেই তারা নারাজ ছিলো। এমনকি মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতো। কিন্তু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলিয়াতের সেই বর্বর নীতিকে পাল্টে দিলেন। নারী জাতির মর্যাদা ঘোষণা করলেন সুউচ্চ কণ্ঠে। সর্বক্ষেত্রে নারীর অবস্থান- ভূমিকা কী হবে,সবই বলে দিলেন। ফলে দীর্ঘ দিনের অবহেলিত নারী জাতি তাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরে পেলো। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মে-কর্মে নারীরা সম্মানের আসনে আসীন হতে শুরু করলো।
ইসলাম ধর্মে সকল বিষয়ের সাথে নারীদের জ্ঞানার্জনের প্রতিও সমান গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমনকি স্বয়ং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিতা স্ত্রী আম্মাজান আয়েশা রাঃ এতোটাই শিক্ষিতা ছিলেন যে, অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ীদের উস্তাদ ছিলেন তিনি। নারী শিক্ষার এই ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন চলে আসলেও মাঝপথে অনেকটাই থমকে যায়। যার কারনে মুসলিম উম্মাহ আবারো ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। আর এটাই স্বাভাবিক যে, নারী জাতিকে শিক্ষা থেকে দূরে রেখে কোনো জাতি আলোর আশা করতে পারেনা।
যাহোক, উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইসলামিক চিন্তাবিদরা এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম নারীরা ইসলামি শিক্ষার একটি মসৃণ পথের সন্ধান লাভ করেছে। স্থানে স্থানে মহিলা মাদরাসা তৈরীর মাধ্যমে উম্মতের দরদীরা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ফলাফল স্বরূপ মুসলিম মিল্লাত নারীদের মধ্য থেকেই আলেমা,হাফেজা আর ইসলামিক গবেষকদের দেখা পাচ্ছে। এটা পুরা জাতির জন্য একটি আশা জাগানিয়া সংবাদ। তবে এই প্রাপ্তির মাঝেও অনেকগুলো অপ্রাপ্তি আমাদের আশার মাঝে আশংকার তৈরি করে ফেলে। বক্ষমান প্রবন্ধে সেই শংকার সমাধানের পথটাই বলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
এখানে আমি আমাদের বাংলাদেশের প্রচলিত মহিলা মাদরাসাগুলোর অতি গুরুত্বপূর্ণ ৩ টি বিষয়ের আলোকপাত করার ইচ্ছা করেছি। তন্মধ্যে প্রথমটি হলো, পাঠদান বিষয়ক। প্রায় সবগুলো মাদরাসা তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সিংহভাগ পুরুষ শিক্ষক দ্বারা সেরে নিচ্ছে। যদিও পুরুষ শিক্ষকেরা বাহ্যত পর্দা রক্ষা করে পাঠদান করে থাকেন, কিন্তু সেটা শরিয়তের মানদণ্ডে কতোটুকু গ্রহণযোগ্য, সেটা বিরাট একটি প্রশ্ন। তাছাড়া অধিকাংশ মহিলা মাদরাসায় শরয়ী পর্দার কোনো বালাই নেই, সেটা দায়িত্ব নিয়েই বলা যাবে। এটা কীভাবে, কীরুপে; সেই ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়োজন। পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষা কার্যক্রম তথা পাঠদান কতোটুকু ফলপ্রসূ সেটা মহিলা মাদরাসা সংশ্লিষ্ট জ্ঞানবান কারো অজানা থাকার কথা নয়। উল্লিখিত দুটি সমস্যা থেকে উত্তরণের নিমিত্তে মহিলা মাদরাসাগুলোতে “শতভাগ মহিলা শিক্ষিকার বিকল্প নেই” কথাটিকে আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক সম্ভব না হলেও অতি দ্রুততার সাথে ব্যবস্থাগ্রহণ আবশ্যক। এমনকি মহিলা বিভাগের প্রশাসনিক দায়িত্বে পরিচালকের স্ত্রী কিংবা মাহরাম ছাড়া কাউকে নিয়োগ দেয়া বন্ধ করে দেয়া অতি আবশ্যক বলেই আমি মনে করি। এক্ষেত্রে ঐ দায়িত্বশীল মাদরাসা পড়ুয়া হওয়া আবশ্যক হয়না। প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য যে কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত মহিলাই যথেষ্ট। অন্যথায় বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা তাদের মূল্যবান সময় অনেকটাই ভুল পথে পরিচালিত করছেন বলে একসময় প্রমাণিত হবে। প্রসঙ্গত প্রশ্ন হবে, এতোসব মহিলা মাদরাসার জন্য এতো মহিলা শিক্ষিকা পাওয়া তো অসম্ভব প্রায়। এর জবাবে বলতে হয়, এটাই আমাদের চিন্তার দৈন্যতা। নতুবা উত্তর দিতে হবে, বছরের পর বছর কাদেরকে মাদরাসা শিক্ষার চূড়ান্ত সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে। ফারিগ হওয়া মেয়েদেরকে যদি কাজে লাগানো সম্ভব না হয়, তবে কি ধরে নিবো যে, এভাবেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলার অলিখিত সংকল্প মাথায় সেট করে রাখা হয়ে গেছে। আমি তো মনে করি, মাদরাসাগুলোতে মহিলা শিক্ষিকা সংকটের প্রধান দুটি কারন হচ্ছে, মহিলা শিক্ষিকাদেরকে পদমর্যাদা ও বেতন নির্ধারণে উপযুক্ত মূল্যায়ণ না করা এবং মহিলা শিক্ষিকার প্রয়োজনই বিবেকে জাগ্রত না হওয়া। যতোদিন পর্যন্ত এ দুই সমস্যা দূর না হবে ততোদিন পর্যন্ত মহিলা শিক্ষিকার সংকটও কাটানো সম্ভব হবেনা। আমরা একথা বুঝতেই চাইনা যে, তৃতীয় বিভাগে পাশ করা একজন মেয়ের সরাসরি পাঠদান, আড়ালে থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করা আলেমের পাঠদানের চেয়েও শতগুণ বেশি ফলপ্রসু।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, একান্ত যদি ক্লাশ নেয়ার মতো মাদরাসা পড়ুয়া উপযুক্ত মহিলা শিক্ষিকা পাওয়া না যায়,তবে লেখাপড়ার মান বৃদ্ধির লক্ষে প্রতি ক্লাসে পুরুষ শিক্ষকের পাশাপাশি যেকোনো শিক্ষায় শিক্ষিত মহিলাকে ক্লাসে সহকারীর ভূমিকায় রাখা যায়। এতে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও মাদরাসা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হবে। এমনকি অল্প দিনেই দেখা যাবে মাদরাসাগুলো থেকে এমনসব মেয়েরা ফারেগ হচ্ছে যারা নিজেরাই মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ কিতাবাদী অনায়াসে পাঠদান করার মহান যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে। কাজেই সম্ভব হলে মাদরাসাগুলোতে শতভাগ মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে অন্তত প্রতি ক্লাসে একজন মহিলা সহকারী নিয়োগ দিতে হবে। এই দুই পন্থার কোনোটিই যদি সম্ভব না হয়, তবে শিক্ষাদানের নামে ছাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আজই বন্ধ করে দেয়া উচিত।
২য় যে বিষয়টি আলোচনা করতে চাই সেটা হলো, মহিলা মাদরাসার আবাসন ব্যবস্থা। আবাসিক মহিলা মাদরাসাগুলোর আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! হাতেগুণা কিছু সংখ্যক মাদরাসার আবাসিক অবস্থা মানসম্মত বলা গেলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই লেখাপড়া কিংবা আবাসনের চরম অনুপযোগী। একটা বন্দী পরিবেশে মাসের পর মাস থাকার ফলে যে কোনো সুস্থ মানুষও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়তে পারে। সেখানে শরীর গঠনের মূল সময়টাতে এরকম অস্বাস্থ্যকর ও ঝুকিপূর্ণ পরিবেশে থাকা-খাওয়া, প্রস্রাব-পায়খানা,গোসল ইত্যাদি চালিয়ে নেয়া কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাজ হতে পারেনা। পুরুষদের মাদরাসার জন্য যেখানে দিনদিন পরিসর বাড়ানোর চিন্তা করা হয়, সেখানে মহিলা মাদরাসার পরিচালকদের উদাসীনতায় উদ্বীগ্ন না হয়ে পারা যায়না। অথচ এ সহজ বাস্তবতা উপলব্ধি করা দরকার ছিলো যে,”একটি অসুস্থ শরীর শিক্ষা অর্জনের পথে চরম প্রতিবন্ধক,পক্ষান্তরে একটি সুস্থ শরীর শিক্ষা অর্জনের জন্য পরম সহায়কই নয় শুধু,আবশ্যকও বটে।” এজন্য শিক্ষার্থিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য মাদরাসার আবাসন ব্যবস্থার প্রতি কর্তৃপক্ষের গভীর সুনজর দরকার।
৩য় আলোচ্যবিষয়টি হলো,’মহিলা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয়!’ একটু জরীপ চালালে দেখা যাবে যে, ছেলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় কয়েকগুণ বেশি। এই অবস্থা অধিকাংশ মহিলা মাদরাসার। যেখানে নারী শিক্ষার দ্বার সহজ করার কথা ছিলো, সেখানে বিভিন্ন অজুহাতে ভর্তি ফি থেকে শুরু করে মাসিক বেতন, আবাসিক বেতন,পরীক্ষা ফি, কল্যাণ ফি’সহ হরেক রকমের ফি ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেকগুণ বেশি পরিশোধ করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে যা অন্যায্য,অহেতুক এবং অতিরঞ্জিত। ছেলেদের মাদরাসায় যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা ফ্রিতে থাকা-খাওয়ার সুবিধা পেয়ে থাকে, মেয়েদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মাদরাসায় সেটা অকল্পনীয়। মোটকথা, পিছিয়ে পড়া মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যতোটা দরদী হবার কথা ছিলো, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। বরঞ্চ এরকম প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে,যেগুলোতে আবাসিক ফি যথেষ্ট পরিমান গ্রহণ করা সত্ত্বেও খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে অতি নিম্নমানের। এসব অপরিনামদর্শী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্ভব না হলে পরিচালকগণ দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করাই হবে নিজের উপর এহসান। কেননা, নিজের সাধ্যের বাইরে বোঝা বহন করতে আল্লাহ তো কাউকে বাধ্য করেননি। পক্ষান্তরে যিনি হটকারিতার আশ্রয় নিয়ে শুধু ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা মূর্খতা হেতু অসাধ্য বোঝা কাঁধে তুলে নেন,তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে তিন শ্রেণীর পক্ষ থেকে আমানত। তার পিতামাতার পক্ষ থেকে আমানত, জাতির পক্ষ থেকে আমানত, সর্বোপরি মহান রবের পক্ষ থেকেও আমানত। তিন শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ এই আমানতের সঠিক পরিচর্যা যদি কারো পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে তার জন্য উচিত আমানতটা যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া। আমানতের খেয়ানত করে নিজের উপর জুলুম না করা।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, সেটা হলো,ইসলাম নারী জাগরণের বিপক্ষে নয়; বরং পক্ষে। এমনকি শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় নারীদের জাগরণ শুধু বৈধই নয়;আবশ্যক। সারাবিশ্বের ইসলামবিদ্বেষীরা আজ ইসলামকে তাদের সমালোচনার লক্ষ বানিয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে নারীদেরকে তারা ইসলামের বিপক্ষে দাড় করাবার ঘৃণ্য অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাই অতিসচেতনতার সাথে বুদ্ধিভিত্তিক লড়াইয়ে এখনই যদি তাদের ঘৃণ্যতাকে রুখা না যায়, তবে গোটা মুসলিম জাতি আবারো জাহিলিয়াতের অমানিশায় হারিয়ে যেতে সময় নেবেনা। অতএব পতনোন্মুখ মুসলিম জাতিকে রক্ষা করতে হলে নারী জাগরণকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আর সে জাগরণটা হবে জ্ঞান বিপ্লবের মাধ্যমেই।
লেখক: শামছুল হক ইবনে সিরাজ