ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী কলোনি : মানবতা বনাম পশুত্বের সংঘাত

মুসা আল হাফিজ


ফিলিস্তিন বনাম ইসরাইলের যুদ্ধকে মানবতা বনাম পশুত্বের সংঘাত বলে আখ্যা দিয়েছে জায়নবাদ। জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান থিওডর হার্জল ১৮৯৬ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের উপনিবেশের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই উপনিবেশ হবে বর্বরদের বিপরীতে সভ্য সমাজের একটা ঘাঁটি। জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান হাইম ওয়াইজমান এসেছিলেন বেলারুশ থেকে। ১৯৩৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘ধ্বংসবাদী শক্তি’, ‘মরু বাহিনী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, ইহুদি ঔপনিবেশিকেরা ছিল, ‘সভ্যতা’ ও ‘সৃষ্টি’কামী। ওয়াইজম্যান পরে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখল প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এটা মরু বাহিনীর বিরুদ্ধে সভ্য জাতির পুরোনো যুদ্ধ। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না।’ সবশেষে অক্টোবর-ডিসেম্বর জুড়ে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরাইলি বর্রতাকে ‘অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর যুদ্ধ, পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবিকতার যুদ্ধ’বলে আখ্যায়িত করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ভালো কথা। কিন্তু এ সংঘাতে কারা পশুত্বের ধারক আর কারা মানবতার নিপীড়িত প্রতিনিধি? ব্যাপারটি খোলাসা করবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি কলোনি গঠনের ইতিহাস। একটু সেদিকে তাকানো যাক।

সুদূর অতীতে
মুসা (আ.) ইহুদিদেরকে মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনান বা ফিলিস্তিনে আনেন খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ১৪০০ সালে। সেখানে আগ থেকে বসবাস করতো ভূমিপুত্র কেনানিরা। তবে সেখানে প্রবেশ করে ইহুদিরা বেশি দিন টিকতে পারেনি। দুই হাজার বছরের বেশি আগে ; ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা বহিরাগত ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিন থেকে একেবারে তাড়িয়ে দেয়। তারপর থেকে তারা ইউরোপের নানা অ লে বসবাস করতে লাগলো।

১৮৮০ সাল
১৮৮০ সাল। তখন ইহুদীরা বেশি ছিল রাশিয়া, জার্মানী ও পোল্যান্ডে। পুরো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে তারা ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সব রাষ্ট্রেই কমবেশি তারা নির্যাতিত হতো। তখন পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার ছিল ব্রিটেন ও উসমানীয় সালতানাত। নির্যাতিত ইহুদীরা এই দুই রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে থাকে। ব্রিটেন শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে না চাইলে সবাই একযোগে তুর্কি অ লে আসতে থাকে। তুর্কি সালতানাত তখন বিশাল। ইহুদী শরনার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে তুর্কি সালতানাতে প্রবেশ করে এবং যার যেখানে সুবিধা সেখানে বসবাস শুরু করে।

১৮৯৬ সাল
ইহুদীদের এই দুরবস্থা নিয়ে তাদের মধ্যে থাকা প-িতেরা কাজ শুরু করে। অনেকেই কাজ করেন, তবে এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন থিয়োডোর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার পুস্তিকা ‘ডের জুডেনস্টাটে’ তিনি ২০শ শতাব্দীতে একটি ভবিষ্যৎ স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন এবং এর জন্য তিনি স্থান নির্ধারণ করেন জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনকে। তার এই পুস্তক ইহুদীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে কিছু ইহুদী এর বিরোধীতা করে। তাদের ধর্মীয় বিবেচনায় তাদের রাষ্ট্রগঠন তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। এই গ্রুপ ছোট হলেও তারা এখনো বিদ্যমান।

১৮৯৭ সাল
সব বাধা উপেক্ষা করে হার্জেল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ ছিল। ১৮৯৭ সর্বপ্রথম বৈশ্বিক ইহুদী সমাবেশ হয় সুইজারল্যান্ডের বাসেলসে এবং তার ধারণা সবার মাঝে ছড়াতে থাকে ব্যাপকভাবে। তার এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা জায়নবাদ নামে পরিচিত হয়।

জায়নবাদ
হিব্রু ভাষায় জায়ন হচ্ছে জেরুসালেমের এক পাহাড়ের নাম। যা জেরুসালেম শহরের প্রতিনিধিত্ব করে। শুরুতে ইহুদীরাই শুধু জায়নবাদী থাকলেও এখন যারা ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান করে তারা সবাই জায়নবাদী হিসেবে পরিচিত। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে যারা মনে করে (সে যে ধর্মেরই হোক না কেন) জেরুজালেম ইহুদীদের অধিকারে থাকবে তারাই জায়নবাদী। এই জায়নবাদীদের একটি কুমিরের সাথে তুলনা করেন সাবেক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তিনি বলেন, জায়নবাদ হল একটি কুমিরের মত। এর উপরের চোয়াল হল আমেরিকা আর নিচের চোয়াল হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর জিহ্বা আর দাঁত হল ইসরাঈল। এর শরীর ও অন্যান্য অঙ্গসমূহ হল মুসলিমদেশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী, মিডিয়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন।

তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ সানি
থিওডোর হার্জেল ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য কলোনী বা উপনিবেশ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ সানির সাথে দেখা করে। বিনিময়ে উসমানীয় সালতানাতের একটি বড় ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। আব্দুল হামিদ তাতে রাজি হননি এবং তাদের দেশ দখলের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে জেরুজালেম ও তার আশে পাশে জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন।

প্রথম আলিয়া (গণঅনুপ্রবেশ)
১৯০২ সালের মাঝে ৩৫,০০০ ইহুদী চলে আসে ফিলিস্তিনে, যেটা এখন ইজরায়েল নামে পরিচিত। তখন সেটা অবশ্য মুসলিম অধিকাওে ছিল। এটাকে বলা হয় প্রথম আলিয়া। আলিয়া হলো ইহুদী পুনর্বাসন, যখন অনেক ইহুদী একসাথে সরে আসে। তখন মুসলিম প্রধান ফিলিস্তিনে দেখা গেল, জেরুজালেমের সিংহভাগই দখল করে নিচ্ছে বহিরাগত ইহুদিরা।

ব্যারন রথচাইল্ড
১৯০৪ সালে হার্জেলের মৃত্যুর পর জায়নবাদকে নেতৃত্ব দেন ইহুদী ধনকুবের ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তক ব্যারন রথচাইল্ড। এই পরিবার দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক প্রভাব তৈরী করে। বিশেষত ব্রিটেন, জার্মানীসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে এবং আমেরিকায় তাদের প্রতিপত্তি নীতিনির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়।

আরব জাতীয়তাবাদ
এদিকে উসমানীয় সালতানাত ভাঙতে মরিয়া ছিল ব্রিটেন। মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট করে তারা। সালতানাতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করে। তাদেরকে বুঝানো হয় অনারব তুর্কি ছোট জাত। তাদের অধিকার নেই আরব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার। আরবদের কাছেই নবী এসেছে তাই আরবরাই মহান। নেতৃত্বের হকদার তারা। আরব নেতাদের মুসলিম বিশ্বের শাসক বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন।

রিভাল চুক্তি
উসমানীয় ভূমি দখলের পর ভাগ বাটোয়ারা করার জন্য ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে রিভাল চুক্তি করে ব্রিটেন।

বেলফোর ঘোষণা
ইহুদীদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে তাদেরকে একটি রাষ্ট্র তৈরিতে সাহায্য করবে। এই বিষয়ে ব্রিটেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেলফোর জায়নবাদী নেতা রথচাইল্ডকে একটি পত্র দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।

বৃটেনের ষড়যন্ত্র
মোটকথা ব্রিটেন আরব নিয়ে একইসাথে তিন পক্ষের সাথে তিনটি চুক্তি করে…
ক. বৃটেন আরবদেরকে আশ্বাস দিল, উসমানীয়দের পরাজিত করতে সাহায্য করলে তারা কুরাইশ বংশের শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে।
খ. ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো, ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নিবে। সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান পাবে ফ্রান্স অন্যদিকে হেজাজ, ফিলিস্তিন, জেরুসালেমসহ বাকী আরব ব্রিটেন পাবে।
গ. জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে ইহুদীদের একটি রাষ্ট্রগঠনের সুযোগ দেওয়া হবে।

১ম বিশ্বযুদ্ধ
১ম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ব্রিটেনকে সাপোর্ট করে। তাদের সহায়তায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স সহজে মধ্যপ্রাচ্য দখল করে। উসমানীয় সৈন্যরা পরাজিত হয়ে চলে যায়। অন্যদিকে ইহুদীরা চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনকে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও গোয়েন্দা সুবিধা দেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি উসমানীয় সরকারে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদী গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় তথ্য ব্রিটেনের কাছে চলে যেত। ১ম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সেনাদের পরাজয়ে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ও ইহুদীরা ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাই এই ফ্রন্টে সহজেই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনারা জয়লাভ করে।

দ্বিতীয় আলিয়া (গণঅনুপ্রবেশ)
১৯১৪ সালের মাঝে দ্বিতীয় আলিয়া হয়ে গেল, ৪০,০০০ ইহুদী এ এলাকায় চলে এলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীরা সমর্থন দেয় জার্মানিকে, কারণ তারা শত্রু রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল। খুবই আইরনিক, না? পরের বিশ্বযুদ্ধেই দেখা গেলো এই জার্মানি ইহুদীদের একদম নিশ্চিহ্ন করতে নেমে পড়েছে!

১৯১৭ সাল
১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইহুদীদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিবে। সেজন্য ইহুদীরা কাজ করতে থাকে। সারাবিশ্ব থেকে চাঁদা তুলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনের গরিব মুসলিমদের থেকে জমি ক্রয় করা শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে জোর করেও দখল নিতে থাকে। সারা পৃথিবী থেকে উদ্বাস্তু ইহুদীদের ফিলিস্তিনে আনা হয় ও তাদের পুনর্বাসন করা হয়।

আমীন আল হুসাইনী
ফিলিস্তিনি জনগণের হৃদয়ে বিপ্লবী চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন আমীন আল হুসাইনী। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার একদল বন্ধুর সহায়তায় বায়ারিক বিপ্লবের মাধ্যমে ইহুদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেন। ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানের দিনে পতাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ফিলিস্তিনি জনগণ। সুযোগ কাজে লাগান আমীন আল হুসাইনী। সবার সামনে বক্তৃতা দিয়ে গরম করে তুলেন রক্ত, জাগিয়ে তুলেন নিজেদের অধিকার রক্ষার প্রতিজ্ঞা। মুসলিম-ইহুদি সংঘর্ষে মারা পড়ে পাঁচ ইহুদি এবং চার ফিলিস্তিনি। পাশাপাশি কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা ছাড়াও উভয় পক্ষের দশের অধিক লোক আহত হয়।

৩য় আলিয়া (গণঅনুপ্রবেশ)
১৯২৩ সালের মাঝে ৩য় আলিয়া হয়, এবং আরো ৪০,০০০ ইহুদী আসে ফিলিস্তিনে।

বুরাক দেয়াল
১৯২৮ সালে ঔঘঈ (ঔবরিংয ঘধঃরড়হধষ ঈড়ঁহপরষ) গঠিত হয় ফিলিস্তিনে। ইহুদিরা বুরাক প্রাচীরে নিয়মিত যাতায়াত তো করতোই, কিন্তু এবার তল্পিতল্পা নিয়ে চলে এলো। ১৯২৮ সালে বুরাক প্রাচীর তাদের ধর্মের জন্য বিশেষ বলে দাবি করে বসলো। ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো ফিলিস্তিনি জনতা। তাদেরকে প্রাচীরের কাছে আসার অনুমতি দেয়া মানে তো, তাদের হয়ে যাওয়া নয়! কুদস শহরের মুফতি আমিন হুসাইনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখে পাঠালেন, ইহুদিরা যেন তাদের এই অহেতুক এবং লোভাতুর দাবি থেকে ফিরে আসে। শুধু এতটুকুই নয়, তিনি বিশাল এক ইসলামি সম্মেলনের আয়োজন করলেন। সম্মেলনে তুলে ধরলেন বিভিন্ন দফা। তারমধ্যে অন্যতম একটি দফা হলো ’ইহুদিরা যে এতদিন বুরাক প্রাচীরের কাছে আসতে পেরেছে, এটা মুসলমানদের অনুগ্রহ। এই জায়গাটি সম্পূর্ণ ইসলামিক দান।’ ব্রিটিশরা প্রলোভন দেখিয়ে, ৫০ মিলিয়ন টাকা ঘুষ দিয়ে আমিন হুসাইনিকে দমাতে চাইলো, পারলো না। তিনি ফিরিয়ে দিলেন তাদের লালসার হাতছানি। ইহুদি যড়যন্ত্র ও ব্রিটিশদের অসাধু পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যক্ত করলেন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। ইহুদিদের বুরাক প্রাচীর দখলের বারংবার প্রচেষ্টা ১৯২৯ সালে সংঘর্ষের জন্ম দেয়। এই সংঘর্ষে ১০ জন মারা যায় এবং উভয় পক্ষ থেকে আহত হয় আরও কয়েকজন। এখানে ইহুদিদের সহায়তায় আবার নাক গলায় ব্রিটিশরা। দশজন ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে তিনজনকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদ- প্রদান করে। ইহুদি এবং জায়নিস্টদের আগ্রাসন এখানেই থেমে থাকে না, এগিয়ে যায়।

৪র্থ আলিয়া (গণঅনুপ্রবেশ)
আর ১৯২৯ সালের মাঝে ৪র্থ আলিয়া হয়, যখন আরও ৮২,০০০ ইহুদী চলে আসে। খরচপাতিতে সাহায্য করত জ্যুইশ ন্যাশনাল ফান্ড, বিদেশি জায়োনিস্টরা এতে সাহায্য করত।

ইজ্জুদ্দীন আল কাসসাম
সিরিয়া থেকে আসা উসমানীয় সেনা কমান্ডার ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিটেন ও ইহুদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পরে সশস্ত্র আন্দোলন করেন। সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জায়ানবাদি বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আল-কাসসাম উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদিদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন। তিনি মুসলিমদের জমি বিক্রয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করেন। যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সময় আল-কাসসাম উন্নত চরিত্রের উপর জোর দিতেন। তাদেরকে অসহায়, অসুস্থদের সেবা, পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়তে বলা হত। শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সাহসী যোদ্ধা হতে এসকল গুণের প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং ইসলামে অনৈতিক বলে বিবেচিত কাজে জড়িত থাকা হাইফার শ্রমিকদের বস্তির বাসিন্দাদের জন্য তিনি নৈতিক শিক্ষা প্রদানে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি বিয়েকে তরুণদের নৈতিক অধঃপতন বন্ধের উপায় হিসেবে দেখতেন। অনেক সহায়হীন সমর্থকদের বিয়েতে তিনি খরচ জুগিয়েছেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। তার অনেক অণুসারী নিরক্ষর হওয়ায় তিনি কুরআনের সাহায্যে তাদের পড়তে ও লিখতে শিখিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি তার যোদ্ধাদেরকে কাদেরিয়া তরিকার বিভিন্ন চর্চা অণুশীলনের উপদেশ দিতেন।

আমিন আল হুসাইনের ফতোয়া
ফিলিস্তিনে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাদের ব্যাপক আবাসনের অনুমতি দেয়। লেবানন, সিরিয়ার মতো বাইরের দেশে বাস করা ফিলিস্তিনি ভূ-মালিকদের থেকে ভূমি কেনার মাধ্যমে জায়নিস্টদের এই আগ্রাসন গতি পায়। এই গতি রুখতে উঠে দাঁড়ান আমীন আল হুসাইনী। তিনি ভূ-মালিকদের তাদের জমিগুলো ইসলামিক কাউন্সিলের কাছে বিক্রি করতে রাজি করান এবং ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দান করার জন্য উৎসাহিত করেন। যেন ইহুদিরা জমিগুলো কিনতে না পারে। তিনি ফতোয়াও জারি করেনফিলিস্তিনের জমি যারা ইহুদিদের কাছে বিক্রি করবে, তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। তাদের জানাযার নামাজ পড়া হবে না, মুসলমানদের কবরে দাফন করা হবে না। এই সময় আমীন আল হুসাইনী ইহুদিদের জমি ক্রয়ের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার জন্য সম্মেলনের আয়োজন করেন। কুদস শহরের আশপাশের মেয়রদের বলেন, ‘ইহুদিদের কাছে অল্প কিংবা বেশি জমি বিক্রি করা, অথবা বিক্রির দালালি করা কিংবা কথায়, কাজে মধ্যস্থতা করা মানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করা। শুধু বিক্রি নয়, বরং প্রতিবাদ না করে চুপ থাকা কিংবা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করাও খেয়ানত। বিষয়টা যেন মাথায় থাকে।’

১৯৩৩ সাল
১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে জাহাজে করে সারা বিশ্ব থেকে ৫০ হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখ-ে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

তিনটি সন্ত্রাসী সংগঠন
ইহুদীবাদীদের তিনটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। আল কাসসাম তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৯৩৫ সাল
১৯৩৫ সালে এক খন্ডযুদ্ধে আল কাসসামকে খুন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। আল কাসসামের শাহদাতের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের টনক নড়ে।

১৯৩৬-১৯৩৯ সাল
১৯৩৫ সালে ইযযুদ্দিন কাসসামের শাহাদাত, ইহুদিদের আধিপত্য এবং কৃষকদের তাদের জমি ও ভূমি থেকে উ”েছদের পর, আমিন হুসাইনি সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, এটা ছাড়া এখন আর কোন গতি নাই। ১৯৩৬ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, যখন শেখ ফারহান সাদীর নেতৃত্বে শেখ কাসসামের বন্ধু ও সহকর্মীরা তুলকর্ম ও জেরুজালেমের রাস্তায় ইহুদিদের গাড়িতে হামলা করে, কার্যত তখনই সশস্ত্র সংগ্রামশুরু হয়ে গেছে। এই হামলায় দু’জন ইহুদি মারা যায়। এরপর কয়েকবার ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। ফিলিস্তিনি জনগণ শহরজুড়ে হারতাল ও অবরোধ পালন করে। ইহুদিদের সহায়তায় মাঠে তখন তৎপর ব্রিটিশ বাহিনী। একপ্রকার তারা ইহুদিদের ঢাল হয়েই দাঁড়াত সবসময়। আমীন আল হুসাইনী স্মৃতিচারণকরে বলেন, ‘তারা যখন আমাকে ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হলো, তারা আমাকে হত্যার হুমকি দিলো। আমাকে পাঠানো তাদের শেষ চিঠিতে তারা লিখেছিলো, ”ইংরেজরা তাদের স্বার্থ ও সাম্রাজ্যের স্বার্থে সবকিছু করতে পারে। এমনকি নির্মমভাবে হত্যাও করতে পারে। তাই তেমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাস করো।’

৫ম আলিয়া
১৯৩৮ সালের মাঝে ৫ম আলিয়া হয়ে গেল, প্রায় আড়াই লাখ ইহুদী এলো ফিলিস্তিনে।

২য় বিশ্বযুদ্ধ
বরাবরের মতো ব্রিটেন আরব এবং ইহুদী- দু’পক্ষকেই হাতে রাখতে চেয়েছে। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনী ভূখ-ে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদীরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে। ১৯৪০ সালে ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত ছিল। সেই ইহুদি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন ইহুদীদের সব দাবি মেনে নিয়ে আপাতত বিদ্রোহ থামায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা বহু ইহুদি হত্যাকা-ের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনী ভূখ-ে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়।

নতুন পরাশক্তি
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন পৃথিবীতে তার একক কতৃত্ব হারায়। নতুন পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার উত্থান হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখ-ে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনী ভূখ-ে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে। ব্রিটেনের গড়িমসি দেখে ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার-হাজার ইহুদিদের বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

কিং ডেভিড হোটেলে বিস্ফোরণ
১৯৪৬ সালের জুলাইতে সন্ত্রাসী দল ইর্গুন কিং ডেভিড হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেখানে ফিলিস্তিনের ইৎরঃরংয ধফসরহরংঃৎধঃরাব যবধফয়ঁধৎঃবৎং ছিল। সে হামলায় মারা যায় ৯১ জন মানুষ, আর আহত হয় ৪৬ জন। ইর্গুন সন্ত্রাসীরা আরবদেশী ওয়ার্কার আর ওয়েইটার সেজে বোম পেতে আসে। বিস্ফোরণে পুরো দক্ষিণ পাশ ভেঙে পড়ে। তখন তেল-আবিব (যেটা বর্তমানে ইজরায়েলের রাজধানী) শহরে কারফিউ জারি করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর বাধ্য হয়ে ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়।

১৯৪৭ সাল
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখ-ে দু’টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখ-ের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ভূখ-ে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অবশেষে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখ- পেল। কিন্তু আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা
জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইহুদিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। এর বিপরীতে আরবদের কোন নেতৃত্ব ছিলনা। ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদীরা। জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বেধে যায়। যেহেতু আরবদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না সেজন্য ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়। ইহুদিদের ক্রমাগত এবং জোরালো হামলার মুখে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনীরা। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনের একজন নেতা আমিন আল-হুসেইনি সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র সহায়তার জন্য। কিন্তু‘ তিনি সাহায্য পাননি। এদিকে সিরিয়া, হেজাজ, মিশর, জর্ডান, লেবানন, ইরাক ইত্যাদি আরব অ লে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা রাষ্ট্রগঠন করেছে ব্রিটেনের গোলাম হয়ে।

১৯৪৮ সাল
জেরুসালেমে চলা দাঙ্গার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। তাদের অস্ত্রগুলো রেখে যায় ইহুদিদের কাছে। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনের ভূমিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের ঘোষণার পরপরই সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত ও রাষ্ট্রহীন হওয়ার বিপর্যয় শুরু হয়। আরবিতে বিপর্যয়কে বলা হয় ‘নাকবা’। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবছর তাই ১৫ মে তারিখটিকে ‘আল-নাকবা’ দিবস হিসেবে পালন করে। আরবরা ইসরাইলে আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি স য়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন আমেরিকা জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে।

যুদ্ধে মারা যায় ইসরায়েলের ৬,০০০ মানুষ। যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ছ লাখ। যুদ্ধবিরতির সময় দু’পক্ষই শক্তি স য় করে। কিন্তু ইসরায়েল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধবিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাঈলী বাহিনী। একর পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদীরা। তেল আবিব এবং জেরুজালেমের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। রাষ্ট্র গঠনের সময় জাতিসংঘ ইসরাঈলকে ফিলিস্তিনের ৫০% জমি দিলেও ইহুদীরা ক্রমাগত তাদের জমি বাড়াতে থাকে। যুদ্ধ হলে ভূমি বাড়ানোর প্রক্রিয়া কিছুদিন বন্ধ থাকে। আর পরিস্থিতি শান্ত হলে ভূমি অধিগ্রহণ বাড়াতে থাকে। ১৯৫১ সালের মাঝেই ইমিগ্রেশনের কারণে ইজরায়েলের জনসংখ্যা হয়ে গেল দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রায় তেরো লাখ।

সুয়েজ খাল সংকট
১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ খাল নিয়ে সংকট তৈরি হয়, তখন ইসরায়েল মিশরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ এবং গাজা উপত্যকায় আক্রমণ করে। কিন্তু সেই সংকটে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ব্রিটেন, ইসরায়েল আর ফ্রান্সকে পিছু হটতে হয়। এদিকে বিশে^ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনবরত ইহুদিদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয়। আর আরবদের তাদের বসতবিঠা থেকে উৎখাত করা হয়। ১৯৫৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় বিশ লাখে।

দ্বিতীয় আরব – ইসরায়েল যুদ্ধ
১৯৬৭ সালে আবার মুখোমুখি হয় আরব–ইসরায়েল। ছয় দিনের এই যুদ্ধ শুরু হয় ওই বছরের ৫ জুন। ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যা ঘটেছিল, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে।
ইসরায়েল বিপুলভাবে জয়ী হয় এই যুদ্ধে। তারা গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়, যা ১৯৪৮ সাল থেকে মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্ডানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। এই সময় আরও ৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়।

PLO (Palestine Liberation Organization)
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দুটি রাষ্ট্র ঘোষিত হলে ফিলিস্তিনী ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র গড়া হলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠন করতে দেওয়া হয়নি। জাতিয়তাবাদী যে নেতারা ব্রিটেনকে ডেকে এনে তাদের স্বাধীনতা নষ্ট করেছে, তারা পরস্পর বিরোধ বাড়ানোর মাধ্যমে কেবল ইহুদীদেরই স্বার্থ রক্ষা করেছে। ৬৭ সালের যুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হারের পর ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী দল ফাতাহর নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে PLO নামে গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন গঠিত হয়। তারা ইসরাঈলীদের সীমানা বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় কারণ চখঙ-এর বহু নেতা ইসরাঈলী অর্থ, নারী ও সুযোগ সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

ইয়োম কিপুর যুদ্ধ
আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে এর পরের যুদ্ধটি ‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের এই যুদ্ধে একদিকে ছিল মিসর আর সিরিয়া, অন্য পক্ষে ইসরায়েল। মিসর এই যুদ্ধে সিনাই অ লে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। তবে গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি। এ যুদ্ধের ফলে সৌদি সরকার ১৯৭৩ সালের তেল সংকট সূচনা করে। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৈরি রাজনৈতিক সংগঠন (পিএলও) জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক দেশের মর্যাদা পায়। ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন।

‘ক্যাম্প ডেভিড’
১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ ওয়াশিংটনে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়) ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘ক্যাম্প ডেভিড’ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। এর ফলে সিনাই উপদ্বীপ থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করে ইসরায়েল। দুই দেশ অধিকৃত অ লে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দেয়ার জন্য একটি চুক্তির কাঠামো সম্মত হয়। তিন বছর পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। ওদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামি বিপ্লব থেকে পালিয়ে আসে ৪০ হাজার ইহুদী। ১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষ চলাকালে ৮০০০ ইথিপিয়ান ইহুদীকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ইজরায়েলে।

প্রথম ইন্তিফাদা
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদা (ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মসজিদ থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন) শুরু করেন। ইসরাইলি বর্বরতা গুলি, হত্যা ও গুমের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

হামাস
ইহুদী চক্রান্ত ও প্রলোভনে আরাফাত ও তার দল বার বার পর্যদস্তু হলে ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। এরা মিশরের ইসলাম্পন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা সংগঠিত হয়। হামাস দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলামপন্থী হামাসের উত্থান দেখে ইসরাঈল ফাতাহকে সমর্থন দেয়। তাদেরকে সরকার গঠন করার সুযোগ দেয়। প্রায় ৪১ বছর পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয়।

আসলো চুক্তিতে
১৯৯৩ সালে তখনকার পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ইসরায়েলের সঙ্গে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে সংঘাতের অবসান ঘটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ওই চুক্তির জন্য ইয়াসির আরাফাত ও তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে অস্ত্র সমর্পন করে চখঙ। বিনিময়ে তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ইসরাঈল আমেরিকাসহ সকল জায়নবাদীদের থেকে সুবিধা পায়। এদিকে ইসরাঈল তার এলাকা দখল বন্ধ রাখেনি। তারা ধীরে ধীরে মুসলিমদের উচ্ছেদ করেই যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র আরাফাতের দল কিছুই করতে পারছিল না। হামাস তার সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ফলে হামাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাম্প ডেভিডে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছায়। তার কয়েক মাস পরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। ইসরায়েলি পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে ফিলিস্তিনি যুবকরা। ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তুতি নেয় হামাস। তার কারণে হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে ফিলিস্তিনে।

২০০৫ সাল
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে গাজা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েলি সৈন্যরা। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নির্দিষ্ট এলাকার ভেতর চলাচল এবং বাইরে আসার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে ইসরায়েল। এতে আন্তর্জাতিক মহলে তারা সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০০৫ এর হিসাব মতে জেরুজালেমে ৭,১৯,০০০ মানুষ বাস করত, যার ৪,৬৫,০০০ ইহুদী আর ২,৩২,০০০ মুসলিম। ইহুদীরা পশ্চিমে, আর মুসলিমরা পূর্ব দিকে বাস করে।

২০০৬ সাল
২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় হামাস। কিন্তু সরকার গঠন করার পর আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ফাতাহ হামাসের সাথে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়।

২০০৭ সাল
অবশেষে ২০০৭ সালে হামাস মুসলিমদের রক্তক্ষয় এড়াতে গাজার একক নিয়ন্ত্রণ নেয় ও পশ্চিম তীর ফাতাহকে ছেড়ে দেয়। এরপর কার্যত ফিলিস্তিন দুইভাগ হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইজরায়েলি এয়ারফোর্স সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ধ্বংস করে দেয়।

২০০৮ সাল
গাজা থেকে রকেট হামলার জবাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে হামাসের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। যাতে নিহত হয় ২০০ ফিলিস্তিনি। পরবর্তীতে, হামাসের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধ শুরু করে তারা। এ ঘটনায় মোট ১২০০ ফিলিস্তিনি ও ১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়।

২০০৯ সাল
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এরপর গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ইসরায়েল এবং স্ট্রিপের সীমারেখা পুনরায় মোতায়েন করা হয়।

২০১২ সাল
২০১২ সালের নভেম্বরে হামাসের সামরিক প্রধান আহমেদ জাবারিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এরপরে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গুলি বিনিময় শুরু হয়। তাতে ১৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং কমপক্ষে ছয় জন ইসরায়েলি নিহত হয়।

২০১৪ সাল
২০১৪ সালে ইসরায়েলের তিন কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা করে হামাস। যার ফলে রকেট হামলা শুরু হয় ইসরায়েলের দিক থেকে। তাতে ১৮৮১ জন ফিলিস্তিনি এবং ৬০ জনেরও বেশি ইসরায়েলির মৃত্যু হয়।

জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ২০১৭ সালে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালে মার্কিন দূতাবাস ইসরায়েলের তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত করে মার্কিন প্রশাসন। ২০১৯ সালে সিরিয়ার গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই তিন পদক্ষেপই ইসরায়েল নিয়ে এযাবৎকালে গৃহীত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন পদক্ষেপ।

২০১৮ সাল
২০১৮ সালের ১৪ মে মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নতুন মাত্রা পেল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয় গাজায়। সেদিন অন্তত ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয় ইসরায়েলি হামলায়। আহত হয় ৩ হাজারের বেশি। ওই ঘটনার পর শতাধিক ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলি ও বোমায় শহীদ হন। ফিলিস্তিনিরা তাদের এই বিক্ষোভের নাম দিয়েছে ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’। অর্থাৎ নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার মিছিল।

‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’
২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বহুল প্রতীক্ষিত ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ প্রকাশ করেন। ট্রাম্পের মধ্যস্থতাতেই আরব রাষ্ট্র বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। পরে আরব আমিরাতও কাজটি করে। অবশেষে ওমান ও সৌদি আরব এই পথে হাঁটতে শুরু করে।

২০২১ সাল
২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি পুলিশ জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে অভিযান চালায়।‘ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান’কে সে অবমাননা করে ইচ্ছে করেই। এখানে আক্রমণ হওয়ায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১১ দিনের যুদ্ধ শুরু হয়। তাতে ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হন, ১৯ জনেরও বেশি ইসরায়েলির মৃত্যু হয়।

২০২২ সাল
২০২২ সালে ইসরায়েলি শহরগুলোতে হামলা হওয়ার পর সেদেশের সেনাবাহিনী ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে কমপক্ষে ১৬৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। বিক্ষোভ হয় ফিলিস্তিন জুড়ে।

২০২৩ সাল
চলতি বছর বেশ কয়েক বার ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনে সামরিক অভিযান চালায়। জানুয়ারিতে পূর্ব জেরুসালেমে দাঙ্গা হয়। চরমপন্থী দখলদার ইহুদিরা যার সূচনা ঘটায়। একটি সিনাগগে ৭ দখলদারকে হত্যা করে একজন ফিলিস্তিনি। এরপর থেকেই শুরু হয় ইসরাইলের তা-ব।

“একটি উন্মুক্ত কারাগার”
হামাস ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েল ও মিশর গাজা উপত্যকার ওপর স্থল, আকাশ ও সমুদ্র অবরোধ আরোপ করে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গাজার অবস্থাকে “একটি উন্মুক্ত কারাগার” এর সাথে তুলনা করেছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের উপর চলাচলের বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি এই অবরোধকে বেআইনি এবং জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে মনে করে। আমদানি এবং প্রায় সমস্ত রপ্তানি সীমিত করে, ইসরায়েলের ১৬ বছরের অবরোধ গাজার অর্থনীতিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে সেখানে বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মতে, গাজার ৬৫ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ খাদ্য অনিরাপদ অবস্থায় আছে। যা গাজা উপত্যকায় বসবাসকারী শিশু কিশোরদের মধ্যে বিষন্নতাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলেছে, “ফিলিস্তিনিদেরকে মাতৃভূমি গাজায় অবাধে চলাফেরা করতে বাধা দেওয়ার কারণে তাদের জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর নিপীড়ন এবং তাদের ওপর বৈষম্যের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।”

অপারেশন তুফান আল-আকসা
তুফান আল-আকসার যুদ্ধ এবং ইস্রায়েলে অপারেশন আয়রন সোর্ডস হলো একটি বর্ধিত সামরিক অভিযান, যা ফিলিস্তিনি গাজা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস দ্বারা শুরু হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিল হামাসের সামরিক বাহিনী কাসসাম বিগ্রেডের সশস্ত্র সৈন্যরা। ৭ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে শনিবার ভোরবেলা বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে মুহাম্মাদ দেইফ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন। প্রথমবারের মতো হামাসের সেনারা ইসরায়েলের ভেতর ঢুকে হামলা চালিয়ে দখলদার ইসরাইলকে হতবাক করে দেয়। এরপর ইহুদীবাদী রাষ্ট্রটি যে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে, তার ভয়াবহতা তাদের কথিত হলোকাস্টের চেয়েও ভয়ঙ্কর। গাজায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আন্তর্জাতিক সকল আইন, যুদ্ধনীতি, মানবাধিকারের ঘোষণা ও সব ধরণের নৈতিকতাকে পদদলিত করছে ইসরাইল।

ইহুদিবাদের লক্ষ্য :
বস্তুত এ হামলা ছিলো আল আকসা রক্ষার চেষ্টা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রবল তুফান। কারণ আল আকসা ভেঙে হাইকলে সোলেমানী তৈরীর ঘোষণা দিয়েছে ইহুদিবাদ। এজন্য লাল গরু জবাই করে কথিত হাইকল তৈরীর দিন-ক্ষণ প্রকাশ করে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারা। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে ইহুদিবাদের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য হলো আল আকসা ভেঙে হাইকলে সোলেমানী তৈরী। তৃতীয় প্রধান লক্ষ্য হলো গ্রেটার ইসরাইল প্রতিষ্ঠা। মিশরের নীল নদ, দজলা-ফোরাত, জর্দান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূখন্ড জুড়ে এই রাষ্ট্র গঠন করতে চায় ইসরাইল। যাকে তারা প্রতিশ্রুত ভূমি বলে আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে তাদের যুক্তির অসারতা নিয়ে আলোকপাত করেছি ফিলিস্তি ও জায়নবাদ : লড়াই ও লিগ্যাসি গ্রন্থে। আগ্রহীরা পাঠ করে নিতে পারেন। ইহুদিবাদের চতুর্থ লক্ষ্য হলো তাদের প্রতিশ্রুত মসিহের আগমন নিশ্চিত করা এবং চূড়ান্ত আরমাগেডান যুদ্ধের মাধ্যমে হাজার বছরের ইহুদি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যপূরণের পথে তারা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবার নীতিতে বিশ্বাসী।

ইসরাইল, আরব ও বিশ্বশক্তি :
ইহুদিবাদের বৃহত্তর লক্ষ্য যে আরবদের জন্য হুমকি, সেই আরবরা মুসলিম পরিচয়ের উপর আরব পরিচয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের সরকারগুলো ইসরাইলের সাথে আঁতাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। মিশর, জর্দানের পরে আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, মরক্কো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে হেঁটেছে। অবশেষে সৌদি আরব এই প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করে। সাম্প্রতিক যুদ্ধটির পেছনে সৌদি ও আরবদের এই ভূমিকাও অন্যতম দায়ী। আরব রাষ্ট্রগুলো নর্মালাইজেশনকে ইসরাইল সমস্যার সমাধান মনে করছে, এটা সকল বিচারে ভুল। কারণ ইসরাইল সমস্যার সমাধান হলো দখলদারির অবসান। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা। বস্তুত ইসরাঈল একটি দখলদার রাষ্ট্র। এর নাগরিকরা বহিরাগত। তাদের থাকার অধিকারের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তবে তারা থাকবে জার্মানীতে নতুবা রাশিয়ায়। সেখানে তাদের আদিনিবাস। আর ইহুদীদের প্রতি আমেরিকার যদি এতই দরদ থাকে, তবে তাদের দেশেই হোক ইসরাইল।

মুসলিম উম্মাহের করণীয় :
ক. উম্মাহভিত্তিক ইত্তেহাদ। হাবলুমমিনাল্লাহ (আল্লাহর রজ্জু) এবং হাবলুমমিনান নাসকে (মানুষ ও মানবতার সহায়ক রজ্জু) আঁকড়ে ধরা।

খ. ফিলিস্তিনের চূড়াš স্বাধীনতা ও পুনর্গঠনের জন্য আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিক সহায়তা জোরদার করা।

গ. সম্মিলিত মুসলিম সেনাবাহিনী গঠন এবং দেশে দেশে আকসার মুক্তির জন্য দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও নিবেদিত জনবলকে সংগঠিত করা।

ঘ. মজবুত ঈমানের সাথে শিক্ষা , প্রযুক্তি, সামরিকতা ও উন্নত কৌশল-বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয়।

ঙ. ইহুদিবাদী প্রতিষ্ঠান ও পণ্য সমূহ স্থায়ীভাবে বয়কট করা এবং পুঁজিবাদী ও ইহুদি নিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থা থেকে মুক্তি

চ. দুনিয়াব্যাপী উপনিবেশ, বর্বরতা ও গণহত্যা বিরোধী গণমতকে সংগঠিত করা। জায়নবাদ বিরোধী ইহুদি-খ্রিস্টান ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদকে সহায়তা করা।

ছ. পশ্চিমাদের সেবাদাস সরকার ও রাজবংশদের হাত থেকে মুক্তির সংগ্রাম। ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের লোক দেখানো লিপ সার্ভিসে প্রতারিত না হয়ে বাস্তবসম্মত ও সত্যিকার ভূমিকার জন্য চাপ তৈরী করা।

জ. নলেজ প্রজক্ট ফর আল আকসাকে বিস্তৃত করা, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আল আকসা বিষয়ক অধ্যয়ন যুক্ত করা, খতিবদের আলোচনা ও প্রচার মাধ্যম সমূহে প্রথম কিবলা বিষয়ক সচেতনতার জোরালো প্রচার।

ঝ. ইহুদিবাদ যেহেতু বিশ্বব্যাপী ইহুদি ঐক্যের ফসল, তাই ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে কেবল ফিলিস্তিনের জনতার উপর ছেড়ে না দিয়ে তাদের সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক তৈরী ও সহায়তা জোরদার। পশ্চিমা বিশ্বে প্রবাসী মুসলিমদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।

ঞ. দেশে দেশে ফিলিস্তিনী প্রবাসী ও শিক্ষার্থীদের সহায়তা। বিশেষত যারা মুক্তিকামী ও সংগ্রামী মানসিকতা পোষণ করেন, তাদের ফ্রি শিক্ষাসহ অন্যান্য সহায়তা বৃদ্ধি।

ট. ইহুদি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকে প্রত্যাখ্যান, তাদের ভাষ্য সমূহকে বর্জন করে প্রতিবয়ান হাজির করা এবং বিকল্প মিডিয়া তৈরী ও ব্যবহার।

ঠ. সামাজিক মাধ্যম সমূহে ইহুদিবাদী প্রচারণার মোকাবেলা এবং হামাশের পক্ষে বৈশ্বিক জনমতকে সংগঠিত করা।

ড. দেশে দেশে সরকার সমূহের সাথে সংলাপের মাধ্যমে আরো উত্তম উপায়ে ফিলিস্তিনে সহায়তা নিশ্চিত করার উপায় ও প্রক্রিয়া অবলম্বনের জন্য চাপ সৃষ্টি। এজন্য সর্বমহলের প্রতিনিধিত্বপূর্ণ প্রভাবশালী জাতীয় কমিটি গঠন ও আল আকসা তহবিল গঠন।

ঢ. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যে সব প্রতিষ্ঠান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের চিহ্নিত করা , প্রত্যাখ্যান করা। ইসরাইলের সাথে বাণিজ্যিক, প্রযুক্তিগত বা অন্য কোনো কৌশলগত সম্পর্ক প্রকাশ্যে বা গোপনে রাখতে পারবে না কোনো মুসলিম রাষ্ট্র, সেজন্য ব্যাপক প্রেসার তৈরী করতে হবে।

ঝ. প্রত্যহ মোনাজাতে ফিলিস্তিনের জন্য দোয়া এবঙ আল আকসার আযাদী ও মুক্তিকামী মুজাহিদদের জন্য বিশেষ মোনাজাত।

শেষকথা : ইসরাইলি রাষ্ট্রগঠনের প্রতিটি ধাপ এবং রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকে আজ অবধি গণহত্যা, উচ্ছেদ, ভূমিদখল ও বর্বরতার সীমাহীন প্রদর্শনী চলমান। নারী-শিশুহত্যা, জাতিগত নিধন, মানবতা ও মানবাধিকারদলন ইসরাইলের রুটিন কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। যা কেবল মানবজাতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে , তা নয়, বরং ন্যায়, সত্য, মূল্যবোধ ও আইন-আদালতের সকল নীতিকে বিধ্বস্ত করছে প্রতিনিয়ত। এ প্রেক্ষাপটে বন্দি, নিপীড়িত, দেশ ও গৃহহারা এবং উন্মুক্ত কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনের মানুষের স্বাধীনতা এবং বায়তুল মাকদিসের পবিত্রতার পুনরোদ্ধার হচ্ছে বিশ্ববিবেকের দাবি, ঈমানের দাবি।


লেখক : লেখক, কবি ও গবেষক

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!