বাংলাভাষা ও সাহিত্যের দিকপাল আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ
আমিনুল ইসলাম কাসেমী ||
শিক্ষাজীবনের শুরুতে মফস্বলে লেখাপড়া করেছি। ইবতেদায়ী থেকে নাহুমীর পর্যন্ত। উর্দু ভার্সনে পড়ালেখা হতো। ‘বাকুরাতুল আদব’, ‘রওজাতুল আদব’ – আরবী শেখার এ কিতাবগুলোর তরজমা প্রথমে উর্দুতে পড়তাম। এরপর বাংলায়। বাংলা বলাটাও শ্রদ্ধেয় উস্তাদের জন্য দুঃসাধ্য ছিল। রওজাতুল আদবের আরবী ইবারতগুলো বাংলা করে পড়ানোটা প্রিয় সেই উস্তাদের জন্য বড় জুলুম ছিল। বলতে চাইতেন না । অগত্যা পীড়াপীড়ি করতে হতো, তখন কিছুটা বলতেন। তাও অনেক কষ্ট হতো তাঁর। আমার এখনও সেই রওজাতুল আদবের আরবী ইবারতগুলোর যে উর্দু তরজমা পড়েছিলাম, সব মুখস্থ আছে। ভুলিনি।
আসলে আমার প্রিয় উস্তাদের কোন দোষ নেই। তখন পরিবেশটা এমনই ছিল। বাংলাভাষা থেকে আমরা দূরে ছিলাম, বহুদূরে। পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি কওমী মাদ্রাসায় আরবী এবং ফার্সী কিতাব পড়ানো হতো উর্দুতে তরজমা করে। ছাত্ররা পরীক্ষায় উর্দুতে লিখে উত্তরপত্র জমা দিতো। সে এক আজব ব্যাপার!
১৯৮৯ সনে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে ভর্তি হলাম। এর পিছনে একটা কারণ আছে, মফস্বলের সেই মাদ্রাসায় থাকতে ‘এসো আরবী শিখি’ কিতাবটি হাতে পেলাম। এরপর শুনলাম, এই কিতাব নাকি মালিবাগ মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।
বাহ! চমৎকার বিষয়! আরবী থেকে সরাসরি বাংলা! বেশ ভাল লাগলো। তাই মালিবাগ মাদ্রাসার প্রতি অন্যধরনের ভালবাসা জন্মে গেল। তাছাড়া কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ) এবং আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.)-এর ভুয়সী প্রশংসা শুনেছি, এতে আরো বেশী প্রেরণা সৃষ্টি হল। তাই মালিবাগে যাওয়ার চিন্তা করলাম।
ভর্তি হলাম হেদায়েতুন্নাহু জামাতে। মালিবাগ মাদ্রাসায় প্রথমদিনের প্রথম সবক ‘হেদায়েতুন্নাহু’। আবার ঘটনাচক্রে প্রিয় উস্তাদ মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেব (মুহাদ্দিস, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা) তখন সবেমাত্র দেওবন্দ থেকে এসেছেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁর প্রথম ক্লাস আমাদের সেই হেদায়েতুন্নাহ কিতাবটির।
আব্দুল গাফফার সাহেব কাজী সাহেবের হাতেগড়া ছাত্র। একজন সুসাহিত্যিক। বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। সাবলিল ভাষা। তিনি হেদায়েতুন্নাহু কিতাব পড়ানো শুরু করলেন। আমার কাছে মনে হলো, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু হলো। সরাসরি মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ। উর্দুর মধ্যস্থতা আর নেই।
সেই বিখ্যাত ‘আল কালিমাতু লফজুন উজিয়া লি মা’নান মুফরাদিন’ এর অনুবাদ সরাসরি মাতৃভাষা বাংলায়। মনটা ভরে যেতো তাঁর দরসে। মনের গহীনে গিয়ে জমা হতো কথাগুলো।
অবশ্য আব্দুল গাফফার সাহেব নিজেও কিন্তু উর্দু ভার্সনে পড়েছেন। সে কেচ্ছা তিনি আমাদের বলেছিলেন। হেদায়েতুন্নাহু তিনি যখন পড়তেন, তখন শিক্ষকদের গলদঘর্ম হওয়া শুরু হয়ে যেতো। বাংলায় পড়াতে পারতেন না।
কওমী মাদ্রাসার এমন জটিল সমীকরণ থেকে উত্তরণের প্রাণপুরুষ হলেন আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ)। যিনি বহু ঝড়-ঝন্জা উপেক্ষা করে ইস্পাতের মতো মজবুত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সতীর্থদের বহু গ্লানি তিনি সহ্য করেছেন। কেউ তাঁকে সমর্থন করেনি, বরং পদে পদে বাধার সম্মুখিন হয়েছিলেন। তারপরেও এক হার না মানা মুজাহিদ তিনি। কওমী মাদ্রাসায় মাতৃভাষা চর্চা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন। পুরো কওমী অঙ্গনে এক তাহরীক গড়ে তুলেছিলেন তিনি, বাংলায় পাঠদান করা। হাদীসের তাকরীর বাংলায়। আরবী থেকে সরাসরি মাতৃভাষায় অনুবাদ। ছাত্রদের নিয়ে বাংলাভাষায় মাসিক দেয়ালিকা তৈরী। বার্ষিক মাগ্যাজিন প্রকাশ। বাংলা সাহিত্যের ক্লাস। লেখালেখি ও বক্তৃতা প্রশিক্ষণ মজলিস। এসব বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তবে কোন জযবার তালে পড়ে নয়, বরং সময় ও যুগের চাহিদানুযায়ী তিনি এই মিশনে অবতীর্ণ হন। তিনি যেরকম একজন বাংলাভাষার সুপণ্ডিত, ঠিক তাঁর এই মিশনকে গতিশীল করতে গড়ে তুলেছেন মাতৃভাষায় প্রাজ্ঞ এক ঝাঁক মেধাবী আলেম। যাদের থেকে এখনো তাঁর সুঘ্রাণ বিচ্ছুরিত হয়। মনে হয় যেন এরা হুবহু কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ’র ফটোকপি।
আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ) বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উচ্চমার্গে আসীন ছিলেন। কোন যেনতেন ব্যক্তি তিনি নন। তাঁর ভাষাজ্ঞান, সাহিত্য-রচনা, বর্ণনা শৈলী এত উচ্চাঙ্গের, যেটা এ ময়দানের বড় বড় ব্যক্তিদের হয়রান করে দেয়। তাঁর একটি গ্রন্থ ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর’ আটশত পৃষ্ঠার এক সুবিশাল রচনা। বইয়ের পরতে পরতে সাহিত্যরস ভাষার অলংকার দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন। তাছাড়া বইটা পড়লে বোঝা যায় কতবড় ভাষাবিদ তিনি ছিলেন।
তাছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদনা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ)। সেসময়ে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের সুপণ্ডিতদের সাথে তাঁর প্রীতি গড়ে ওঠে। যারা কাজী সাহেবকে অপরিহার্য ব্যক্তি মনে করতেন।
এককালের বাংলাভাষা সাহিত্যের সেরা মানুষ, প্রথিতযশা পণ্ডিত, আ ফ ম আব্দুল হক ফরিদী, ড. সিরাজুল হক, ড. একে এম আইয়ুব আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান, ভাষাবিজ্ঞানী ড. কাজী দ্বীন মুহম্মদ, ড. মুস্তাফিজুর রহমান, ড. শমসের আলী, ড. আ ত ম মুসলেহ উদ্দীন, কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর – এমন মহান ব্যক্তিদের সাথে কাজী সাহেব ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদনা পরিষদে কাজ করেছেন। এই সকল ব্যক্তিগণ আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহঃ) এর বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতা এবং পাণ্ডিত্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন।
একজন দেওবন্দী আলেম নিজের মাতৃভাষার উপর এমন পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন কীভাবে? আসলে প্রশ্নটা বড় কঠিন। কাজী সাহেব সাহিত্য চর্চায় যে মেহনত করেছেন, যেভাবে তিনি পড়ালেখা করেছেন, সেটা ঈর্ষনীয়। নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল। বক্তৃতার মাঝে পঙক্তিগুলো যেভাবে বলতেন, সেটা অকল্পনীয়।
ক’টা কবিতার চরণ আর আমরা মুখস্থ করেছি, কাজী সাহেবের শত শত চরণ মুখস্থ ছিল। আর যথা সময়ে তাঁর যবান থেকে এসব নিঃসৃত হত। কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো নজরুলের কবিতায় মজলিসকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন তিনি। প্রায়শঃ আবৃত্তি করতেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল একলা চল একলা চল রে।” আবার কখনো দরাজ কণ্ঠে বলতেন, “মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না…।”
কুতুবুল আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহঃ) এর অন্যতম ছাত্র তিনি, যাকে ‘স্বপ্নের রাজপুত্তুর’ মনে করতেন। তাঁরই সংস্পর্শে মূলতঃ তিনি নিজেকে রাঙিয়ে ছিলেন। তরঙ্গায়িত সমুদ্রের নির্ভিক নাবিক বলা হয় আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.)-কে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, চারিদিকে অথৈ জলরাশি। কূলকিনারা নেই। সেই তরঙ্গের মাঝে তিনি অতিসতর্কতার সাথে জাহাজের নোঙর ফেলেছেন। কঠিন ধৈর্য্য, প্রবাদতুল্য অধ্যবসায়, সীমাহীন ত্যাগ আর কুরবানীর বদৌলতে এদেশের কওমী মাদ্রাসাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেকেলে ভাব থেকে আধুনিকায়ন, মাতৃভাষার সাথে আলেমদের সম্পৃক্তকরণ, আজকে বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাতে ভাষাসাহিত্যের যে জাগরণ চলছে, এসব তাঁরই অবদান। এই যে তাঁকে নিয়ে দু-কলম লেখা, এটাও তাঁরই সংস্পর্শ সৌরভ ও সান্নিধ্য সৌভাগ্যে। এ সবকিছুর মূলেই ভাস্বর হয়ে আছেন আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সমাসীন করুন, আমীন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট