মুফতিয়ে আযম আব্দুস সালাম চাটগামীর বর্ণাঢ্য জীবন

উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল ঊলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর নবনির্বাচিত মহাপরিচালক, প্রধান মুফতি মুফতিয়ে আজম (গ্রান্ড মুফতি) আব্দুস সালাম চাটগামী। পাকিস্তানের জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া বানূরী টাউন করাচির সাবেক প্রধান মুফতি তিনি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার নলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এ মনীষী। গ্রামের মাদরাসায় প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের জিরি মাদরাসায় চার বছর পড়াশুনা শেষে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন।

উচ্চশিক্ষা : ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তানের বিখ্যাত জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া আল্লামা বানূরী টাউন করাচিতে ভর্তি হন। সেখানে উচ্চতর হাদীস ও ফেকাহ নিয়ে পড়াশুনা করেন। ফিকাহ পড়াকালিন প্রচলিত ব্যবসায় স্বত্ব বিক্রি ও একটি তাত্ত্বিক আলোচনা শিরোনামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৈরি করেন। আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. অভিসন্দর্ভটি পূর্ণ যাচাই-বাচাইয়ের পর মুমতাজ (ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট) সনদ প্রদান করেন। এ ছাড়াও মুফতি ওলি হাসান টুংকি রহ. নিজের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সনদ প্রদান করেন। পড়াশুনা শেষেই ঐ জামেয়াতেই কার্যকরি মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মুফতি আযম ওলি হাসান টুংকির অসুস্থার পর তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান মুফতির কাজ আঞ্জাম দেন। তিনি মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে নিজ অবস্থান ধরে রাখেন। মুফতি ওলি হাসান টুংকির ইন্তেকালের পর বিশ্ববিখ্যাত এ জামেয়ার প্রধান মুফতি হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।

আল্লামা চাটগামীর ইতিহাস সৃষ্টি : আল্লামা আব্দুস সালাম চাটগামী পাকিস্তানের বানূরী টাউন করাচিতে দীর্ঘ ৩০বছর অবস্থানকালে প্রায় ৩লক্ষ লিখিত ফতোয়া দিয়েছেন। যা জামেয়া বানূরী টাউন করাচির ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক। বানূরী টাউনের দারুল ইফতায় ৬০ খণ্ড সম্বলিত রেজিস্ট্রি বইতে এসব সংরক্ষিত আছে। ফলে দেশের মাটি পেরিয়ে বিদেশেও মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী নামটি সমুজ্জ্বল।

ঐতিহাসিক ফতোয়া গ্রন্থ ‘জাওয়াহিরুল ফাতওয়া’ :  ফতোয়া গ্রন্থের জগতে সাড়া জাগানো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘জাওয়াহিরুল ফাতওয়া’। আলোড়ন সৃষ্টিকারি এ গ্রন্থের মাকবুলিয়্যাত স্বয়ং রাসূল সা. এর মাধ্যমে স্বীকৃত। স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূলে আরাবী সা. গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন! ‘জাওয়াহিরুল ফাতওয়া’র নতুন এডিশনে এ স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ৪খণ্ডের জাওয়াহিরুল ফাতওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের করাচির শীর্ষ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশী এ মহান লেখকের একাধিক গ্রন্থ ছাপানো হয়েছে।

আল্লামা চাটগামীর রচনাবলী:  ১. জাওয়াহিরুল ফাতওয়া ৪খণ্ডে প্রকাশিত। ৫ম ও ৬ষ্ঠ খণ্ড প্রকাশিতব্য! (উর্দু) ২. আপকা সুওয়াল আওর উনকা জওয়াব আহাদীছ কি রৌশনি মেঁ (উর্দু) ৩. ইসলামী মায়িশাত কে বুনয়াদী উসূল (উর্দু) ৪. ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানব অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয়।(বাংলায় অনূদিত) ৫. রহমতে আলম সা. এর মকবুল দোয়া (উর্দু-বাংলা) ৬. মুরাওয়াজা ইসলামী ব্যাংকারী (উর্দু) ৭. হায়াতে শায়খুল কুল ৮. তাজকেরায়ে মুখলিছ ৯. মাকালাতে চাটগামী।

মাতৃভূমিতে ফেরা :  ২০০০সালে স্বদেশের ভালবাসা এবং দারুল উলূম হাটহাজারীর মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেবের আহবানে মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী বাংলাদেশের ফিরে আসেন। ২০০১ সালে দারুল উলূম হাটহাজারীতে খেদমত শুরু করেন। মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী দারুল উলূম হাটহাজারীতে নিয়োগের পর ২ বছর মেয়াদি উচ্চতর উলূমুল হাদীছ বিভাগ চালু করা হয়। বিভাগটি ইতোমধ্যে হাদীস গবেষণায় নতুন নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

যেভাবে বাংলাদেশের গ্র্যান্ড মুফতি : দেশে ফিরে হাটহাজারীতে নিয়োগের সময় বাংলাদেশের গ্রান্ড মুফতি ছিলেন আল্লামা আহমদুল হক রহ.। তার ইন্তেকালের পর আল্লামা চাটগামীকে বাংলাদেশের ‘মুফতি আযম’ হিসেবে মনোনীত করা হয়। ‘বড় মনের’ মানুষ হিসেবে পরিচিত এ মহান মনীষী বিরতহীন ইসলামের খেদমত করে গেছেন দুনিয়াবিমুখ আল্লামা চাটগামী রহ.।আল্লামা চাটগামীর রয়েছে নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই-এ প্রতিষ্ঠা করেছেন, দারুল ইফতা খাদেমুল কুরআস ওয়াস সুন্নাহ নামে ব্যতিক্রমধর্মি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ, উচ্চতর কেরাত ও হেফজ বিভাগ রয়েছে। দেশ-বিদেশে পরিচিত বাংলাদেশের মুফতি আযম বর্তমানে বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগে ভুগছিলেন। তবু দীর্ঘদিন ধরে ইলমে ফিকাহর খেদমত, দারুল উলূম হাটহাজারীর ইফতার বিভাগের ছাত্রদের তামরীন দেখতেন, শুনতেন ও দস্তখত করতেন।

ইন্তেকাল : আজ সকাল ১০টা থেকে শুরা বৈঠক চলছিলো। উনাকে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এ দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দিতে উনাকে ডেকে পাঠানো হয়। এর পরপরই সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আজ ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় হাটহাজারী মাদরাসা মাঠে উনার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। এবং মাদরাসার ‘মাকাবারায়ে জামিয়া’তে দাফন করা হবে।

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!