মেধাবী আলেমরা খ্যাতির জন্য সহজ পথ বেছে নেন: গাজী আতাউর রহমান
আওয়ার ইসলামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া
রাজনীতি নিয়ে দেশের শীর্ষ আলেমদের মনোভাব কেমন, তা হাইআতুল উলয়ার মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকদের সর্বপ্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে আবারো নতুন করে ফুটে ওঠলো। এই সিদ্ধান্ত হাইআ নিতে পারে কি পারে না বা বস্তবায়ন কিভাবে করবে, তা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও দেশের শীর্ষ আলেমগণ যে রাজনীতিতে ভীষণভাবে অনাগ্রহী এবং তারা যে তাদের ছাত্রদেরকে রাজনীতি বিষয়ে প্রচন্ডভাবে নিরুৎসাহিত করেন, এ সিদ্ধান্তে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। এ বিষয়ে দেশের চারজন মেধাবী এবং জনপ্রিয় আলেমের মন্তব্যধর্মী একটি প্রতিবেদন করেছে, অনলাইন নিউজপোর্টাল আওয়ার ইসলাম।
চারজনই আমার মোহাব্বতের প্রিয় মানুষ। এদের একজন মাওলানা লিয়াকত আলী। ছোটকালে ছত্রজীবনে মাওলানা লিয়াকত আলীর আলোচনা শুনে ইসলামী রাজনীতির প্রতি প্রেরণা লাভ করেছিলাম। খেলাফত আন্দোলনের বিপর্যয়ের পর ১৯৮৬ সালে খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িত কওমি মাদরাসার মেধাবী ছাত্রদের উদ্যোগে ছাত্র তানজিম নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠেছিল। মাওলানা লিয়াকত ভাই ছিলেন সেই ছাত্র সংগঠনের নাজেমে আলা বা সেক্রেটারি জেনারেল। মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ আল ফরিদী ছিলেন কায়েদে আলা বা সভাপতি। আমি ছিলাম কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বকণিষ্ট দায়িত্বশীল।
তৎকালীন সময় গুলশান ২ নম্বরের কেন্দ্রীয় পার্কে অনুষ্ঠিত ছাত্র তানজিমের এক সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে লিয়াকত ভাই বলেছিলেন, “খেলাফত আন্দোলন ভেঙে গেছে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে , ছাত্র তানজিম জন্ম হয়েছে আগামীদিনের ইসলামী রাজনীতিতে কিছু যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির জন্য। “লিয়াকত ভাই হয়তো সে দিনের কথা ভুলে গেছেন; কিন্তু আমি তার হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য কখনো ভুলতে পারিনি। লিয়াকত ভাই সম্ভবত কওমি মাদ্রাসার একমাত্র ছাত্র যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে মাস্টার্স করে মাদরাসায় হাদিসের দরস দেয়ার পাশাপাশি একটি মূল ধারার জাতীয় দৈনিকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সাব এডিটর -এর দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি ইসলামী রাজনীতির ত্রিসিমানায়ও নাই।
মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীনও ছাত্রজীবনে একজন যোগ্য সংগঠক ছিলেন। তিনি যখন বাড়ীধারা মাদরাসায় লাজনাতুত তালাবা করতেন, তখন আমরা যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ছাত্র তানজিম করতাম। তিনি তার সংগঠনের কাজে প্রায়ই যাত্রাবাড়ী যেতেন। আমাদের সংগঠন ভিন্ন হলেও সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। তিনিও এখন কোন সংগঠনের সাথে নাই। তিনি এখন দেশের একজন জনপ্রিয় খ্যাতিমান লেখক।
যাইনুল ভাইয়ের শশুর মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদীর একটি দামি কথায় আমি দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে ছিলাম। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে এক সাক্ষাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মাওলানা! ইসলামী আন্দোলনে আপনারা যারা আলেম আছেন; তারা সব সময় সংগঠনের কাজে সক্রিয় থাকবেন। দলটি যাতে কোন দিন বিচ্যুত না হয়। আমাদের ইসলামী দলগুলোর অবস্থা কিন্তু ভালো নয়। “আমার কেন যেন মনে হয়, মরহুমের সেদিনকার কথাগুলো ইলহামি কথা ছিল।
আরেকজন মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী। বাংলাদেশে বহুমূ্খী প্রতিভাধর হাতেগোনা যে কয়জন সচেতন আলেম আছেন, তাদের মধ্যে তিনি একজন। দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়। আমার রাজনৈতিক জীবনে তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি এবং শিখেছি। তিনি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা কওমীর সন্তান হয়েও ছাত্র জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতি করেছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে নেজামে ইসলামের সভাপতি মরহুম আতহার আলী রহ.-এর সেক্রটারী ছিলেন। জনগণের ভোটে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শৈশবকাল থেকে যে মানুষটি রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠেছেন, যার মধ্যে রাজনৈতিক সকল কোয়ালিটি বিদ্যমান, সেই নদভী ভাই রাজনীতিতে সক্রিয় নন। তবে নদভী ভাই আমাকে কথা দিয়েছেন, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে, আগামী দিনের ইসলামী রাজনীতিতে তিনি সিরিয়াস হবেন। (আল্লাহ কবুল করুন)
আরেকজন বহুগুনের আলেম, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তাঁর সঙ্গেও আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি যখন লালবাগ মাদরাসায় পড়ি, তখন তিনিও একই জামাতে কামরাঙ্গীর চড়ে পড়েন। তিনিও ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। কথা এবং যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে বিমোহিত করার অসাধারণ দক্ষতা তাঁর রয়েছে। তিনি লেখেনও খুব ভালো। তিনি এখন রাজনীতিমুক্ত।
চরজন প্রবিভাধর আলেমই তাদের স্বভাবজাত মুন্সিয়ানার সাথে অত্যন্ত চমৎকারভাবে হাইআতুল উলয়ার সিদ্ধান্তের যতার্থতা ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড এজন্য বয়ান করলাম, যাতে বর্তমান প্রজন্ম কিছুটা হলেও আমাদের ইসলামী রাজনীতির দুরবস্থার কারণটা উপলব্ধি করতে পারে। আমাদের মেধাবী আলেমরা খ্যাতির জন্য সহজ যে কোন পথ বেছে নেন। রাজনীতির মতো জটিল ও চ্যালেঞ্জিং কাজে ধারাবাহিকভাবে লেগে থাকতে চান না।
যারা নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য রাজনীতিভিন্ন অন্য কোন প্রয়োজনীয় খেদমত বেছে নেন, তাও ‘তাকসীমে কার’ -এর সূত্র অনুযায়ী নিন্দনীয় কোন বিষয় নয়। কিন্তু যদি কারো স্ববিরোধী অবস্থান এবং বক্তব্যের কারণে দীনের একটি বড় দায়িত্ব অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার হয়; তাহলে তা সামগ্রিক দীনের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়।
মাদরাসায় রাজনীতি প্রসঙ্গে চারজন তারকা আলেম আওয়ার ইসলামে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, হাইআর সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিন্তু তাদের ব্যাখ্যা খাপ খায়নি। কারণ, হাইআ মাদরাসার অভ্যন্তরে রাজনীতির বিষয়ে কিছু বলেনি। হাইআ পরিষ্কারভাবে বলেছে, মাদরাসার ছাত্র শিক্ষদের সর্বপ্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ।
এখন মাদরাসার ভিতরে যদি আওমী লীগ এসে রাজনীতি করে বা বিএনপি এসে রাজনীতি করে বা অন্য কেউ এসে রাজনীতি করে তাহলে কিন্তু কোন বাধা থাকবে না। শুধু মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরা জড়াতে পারবেন না।
নদভী ভাই যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যয়নুল ভাই হাইআর সিদ্ধান্তকে ইসলামী রাজনীতির বিকাশের জন্য সহায়ক বলে যে সরল যুক্তি দিয়েছেন, এসব তখনই ফলপ্রসূ হতো যদি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের এখতিয়ার বা ক্যাপাসিটি হাইআর থাকতো। বাস্তবতা হলো, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে যারা যখন ক্ষমতায় থাকবে তাদের প্রশাসন এবং তাদের স্থানীয় ক্যাডার ও নেতারা। তারা আপনার আমার কাছে ব্যাখ্যা চাবে না, তাদের সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করে নিবে।
তাছাড়া এ সিদ্ধান্তর ফলে মাদরাসার সাধারণ ছাত্র শিক্ষকগণও মুহতামিম বা কমিটি কর্তৃক ব্যাপক হয়রানীর সম্ভাবনা রয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পরে মাদরাসার কোন ছাত্র শিক্ষককে মাদরাসার ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতি করার দায়ে যদি শাস্তি দেয়া হয় বা বহিস্কার করা হয়, তাহলে কিন্তু হাইআ এসে তাদের পাশে দাড়াবে না।
এ সিদ্ধান্ত উসূলে শরিয়ার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ন নয়। কারণ, রাসূলে আকরাম স. মসজিদে নববীতে বসে রাজনীতি করেছেন, রাষ্ট্র চালিয়েছেন। অতএব, মাদরাসা মসজিদে ইসলামী রাজনীতি বা দীনি আন্দোলনের কার্যক্রম আলেমদের কোন সংস্থা নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব নিতে পারে না। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে যারা এদেশে নানাহ প্রতিকূলতার মধ্যে ইসলামী রাজনীতিকে এখলাসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাদেরকে এক ধরনের অপমান ও অবজ্ঞা করা হয়েছে।
এমনিতেই ইসলামী রাজনীতিতে মেধাবী আলেমদের উপস্থিতি হতাশাজনক। এই সিদ্ধান্তের ফলে ইসলামী রাজনীতিতেও ভবিষ্যতে ওলামা নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূলত রাজনীতিতে মেধাবী আলেমদের অনাগ্রহের কারণেই দুর্নীতিবাজরা আজ সমাজের সর্বত্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা দীর্ঘমেয়াদে দুর্নীতিবাজদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে, এর পরিবর্তনের যথাযথ চেষ্টা কৌষল না করে, ওয়ারাসাতুল আমমম্বিয়া হিসেবে তৃপ্তির ঢেকুর দিতে পারি না।