যাকাত প্রদানের সর্বোত্তম খাত

মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান

প্রধানত যারা যাকাত গ্রহণের অধিকার রাখেন, তাদের ফিরিস্তিতে যাকাত উপযুক্ত নিজের আত্মীয় স্বজন, পরে প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব, এরপরে যাকাতের অন্যান্য উপযুক্তরাই স্থান পায়। তবে যাকাতের অর্থব্যয়ের সবচেয়ে নিরাপদ খাত হলো–মাদরাসা, এতিমখানা ও নিরেট এতিম-গরিবদের জনস্বার্থে ব্যয়িত সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে যে সব মাদরাসায় এতিম-গরিবদের আলাদা ও স্বতন্ত্র ফান্ড রয়েছে এবং তাদের জন্য বিনামূল্যে নাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, সে সব মাদরাসায় যাকাত প্রদান সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম। কারণ, এতে যেমন আপনার যাকাত সুষ্ঠুভাবে আদায় হবে, তেমনি এ অর্থ দিয়ে সারাদেশে অসংখ্য মাদরাসা স্থাপিত হবে। দীনি ইলম ও ইসলামি জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি হবে। কোরআন-হাদিস শিক্ষার ও শিক্ষা দেয়ারও ব্যবস্থা বহাল থাকবে। আর এ প্রত্যেকটি কাজই সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

বর্তমানে মিডিয়া ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘মাদরাসায় যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না’ মর্মে প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। এতে জনগণ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। অনেক যাকাতদাতা মাদরাসায় যাকাত প্রদান থেকেও বিরত থাকছেন। যে কারণে জনগণের অর্থে পরিচালিত এসব মাদরাসার আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে। দীনি শিক্ষা-দীক্ষাও গতিরুদ্ধ হচ্ছে। এ অপপ্রচার বিশেষ কোনো এজেন্ডার বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্র কিনা–খতিয়ে দেখা দরকার।

এতে সন্দেহ নেই যে, যাকাত প্রদানের সর্বোত্তম খাত হলো মাদরাসা। কারণ, মাদরাসাগুলোতে এতিম-গরিবদের জন্য স্বতন্ত্র ফান্ড থাকে। যেটি সম্পূর্ণ জনগণের যাকাত-সদকা ও বিভিন্ন দান-অনুদানে পরিচালিত। এ ফান্ডে জমাকৃত অর্থ দিয়ে এতিম-গরিব শিক্ষার্থীদের ভরণ-পোষণ করা হয়। তারা কোরআন-হাদিস শিক্ষা ও ইসলামি জ্ঞানচর্চা করে বড় মাপের আলেম হয়ে দীনের প্রভূত সেবাদান করে থাকবেন–এমনটিই প্রত্যাশা। সেমতে, মাদরাসায় যাকাত দেয়া সর্বাধিক উত্তম বলে প্রতিভাত হয়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘যাকাত কেবল ফকির-মিসকিন, গরিব-এতিম ও যাকাত উসুলকারী এবং যাদের চিত্তাকর্ষণের প্রয়োজন তাদের আর তা দাসমুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে এবং আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্যে। এটিই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সূরা তওবা : ৬০)

বিবেচনার বিষয় হলো, আল্লাহ কৃর্তক নির্ধারিত যাকাত উপযুক্তরা যদি আপনার যাকাতের অর্থে ইসলামের কোনো ফলপ্রসু কাজে নিয়োজিত থাকে, তাহলে আপনার সওয়াব হবে দ্বিগুণ। এক তো যাকাত আদায়ের সওয়াব, অন্যটি হবে ইসলামকে সমুন্নতকরণের সওয়াব। অতএব, যারা বলে থাকেন–মাদরাসায় ব্যয়িত যাকাত সহীহ নয়, তাদের কথা ঠিক নয়।

তবে জেনে রাখা ভালো, যাকাতের অর্থ দিয়ে মাদরাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দেয়া, ভবন নির্মাণ ও সাধারণ খরচ সম্পূর্ণ নাজায়েয। সেমতে, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এটি নিশ্চিত করে যে, তারা যাকাতের খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে কখনো যাকাতের অর্থ ব্যয় করে না।

আরেকটি বিষয় সাফ থাকা দরকার যে, এদেশে দুই ধরনের মাদরাসা শিক্ষার প্রচলন রয়েছে। এক ধরনের মাদরাসা সরকারি। যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারের বিভিন্ন অনুদানে হয়ে থাকে। যদি এসব মাদরাসায় যাকাত আদায়ের খাত থাকে আর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যাকাত উপযুক্তদের মধ্যে শরীয়তসম্মত উপায়ে যাকাতের অর্থ ব্যয় করে থাকে, তাহলে এ ধরনের সরকারি মাদরাসাতেও যাকাত দেয়া যাবে। তবে যে সব মাদরাসা সরকারি অনুদানভুক্ত নয়, তাতে কেবল যাকাতের বেলায়ই নয়, বরং সাধারণ দান-অনুদান, সদকা-ফিতরা ইত্যাদির বেলায়ও প্রাধান্য দেয়া চাই। কারণ, এসব মাদরাসার ছাত্ররা মূলত রাসূলের সুন্নতের ধারক-বাহক। তাদের মাধ্যমে শরীয়তের ভিত্তি দাঁড় হয়ে আছে।

কেয়ামতের দিন শরিয়ত সম্পর্কে প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত পেয়ে ধন্য হওয়ার বিষয়টি পরিপূর্ণ শরিয়তের সাথে জড়িত। সমস্ত নবী রাসূল–যারা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, তারা সকলেই ইলম শিক্ষা করা, শিক্ষা দেয়া, শরিয়তের হুকুম-আহকামের পাবন্দি করার দাওয়াত দিয়েছেন। আর এর ওপরই চিরমুক্তি ও সফলতা নির্ভরশীল বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন। এজন্যেই এ নশ্বর পৃথিবীতে তাদের শুভাগমন হয়েছে। তাই এ খাতে সঠিক সাহায্য-সহযোগিতা করা যে সর্বোত্তম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পক্ষান্তরে এসব মাদরাসা ও এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন করা, তাদের অসহায়তা ও দুঃখ-দুর্দশার প্রতি কটাক্ষ বা অবহেলা প্রদর্শন করা আল্লাহ পাকের কঠোর আজাব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণও হতে পারে।

তাছাড়া ইমাম গাযালি রহ.-এর মতানুসারে যাকাত দেয়ার জন্য এমন অভাবগ্রস্ত লোকদের অনুসন্ধান করা–যারা দুনিয়ার লোভ-লালসা, ধনলিপ্সা ও অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে আখেরাতের পাথেয় নিয়ে নিমগ্ন রয়েছে কিংবা যারা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশমতে হালাল খাবার খেয়ে বেঁচে আছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যারা ভালো কাজ করে তাদেরকে নিজ মাল থেকে খানা খাওয়াও। কারণ, তারা সর্বদাই আল্লাহমুখী থাকে। তারা আর্থিক সংকটে পড়লে অন্যমনষ্ক হয়ে যেতে পারে। তাই এ ধরনের মানুষকে আল্লাহমুখী করে রাখা দুনিয়াদার হাজার লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করা থেকে উত্তম। আর আল্লাহওয়ালা হাজার লোকের তুলনায় এমন একজনকে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা উত্তম– যিনি আলেম, গরিব, অসহায় অথচ কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একনিষ্ঠভাবে নিরলস ইলমে দীনের সেবাদান করে যাচ্ছে। কারণ, ইলম শেখা ও শেখানো সর্বোত্তম আমল।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস জগদ্বিখ্যাত মনীষী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক–যার সনদে বুখারি শরিফে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি অত্যন্ত সম্পদশালী ছিলেন। তিনি নিজের যাকাতের সমস্ত মাল ওলামায়ে কেরামের পেছনে ব্যয় করতেন আর বলতেন–‘নবুওয়তের মর্যাদার পর সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা হচ্ছে ওলামায়ে কেরামের। তারা অভাবগ্রস্ত হলে, অর্থসংকটে পড়লে দীনের খেদমতে ভাটা পড়বে ও দীনের বিশাল ক্ষতি হবে। তাই তাদেরকে ইসলামের সেবাদানের জন্য অর্থনৈতিকভাবে চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যেন তারা নিশ্চিন্তে ইসলামের খেদমতে নিমগ্ন থাকতে পারে।’

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে পারেন মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিজাহুল্লাহ রচিত ‘যাকাতের মাসআলা মাসায়েল’ নামক গ্রন্থটি। বইটি পাওয়া যাবে যাত্রাবাড়ি মাদরাসা সংলগ্ন কিতাব মার্কেটে এবং বাংলাবাজারের মাকতাবাতুল আবরারে।

লেখক: মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!