লজিংবাড়ির সাতকাহন

এই তো গত শতাব্দীতেও লজিং ছিল বাংলা অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। গ্রাম হোক কিংবা শহর, মোটামুটি বড় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানেই থাকত, আশপাশের এলাকায় প্রায় ঘরে ঘরেই ছিল ছাত্রদের লজিং খাওয়ার ব্যবস্থা। গরিব-ধনী নির্বিশেষে প্রায় সকলেই একেকজন শিক্ষার্থীকে নিজের ঘরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা দিতেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। অধিকাংশ লজিংবাড়িতে অবশ্য একটা শর্ত থাকতÑসন্ধ্যার পর একবেলা পরিবারের ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের পড়াতে হবে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গত শতাব্দীর শেষ অবধি আমাদের রাজধানী-শহর ঢাকায়ও ছিল লজিংয়ের প্রথা। বকশিবাজারের মাদরাসা-ই-আলিয়াসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের লজিং দিতেন পুরান ঢাকার অধিবাসীরা। কিন্তু এই শতাব্দীতে এসে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরগুলো থেকে লজিংপ্রথার পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটে গেছে। গ্রামাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় অবশ্য এখনও জারি আছে এই প্রথা, কিন্তু আগের সেই জৌলুশ ও আগ্রহ নেই কোনোখানেই।

পারিবারিক গল্প দিয়েই শুরু করি। আমি-সহ আমাদের পরিবারের ধারাবাহিক তিন প্রজন্মের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সিংহভাগই হয়েছে লজিংবাড়ির খাবার খেয়ে।

দাদাকে দেখিনি, আমার জন্মের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। দাদুর মুখে প্রায়ই একটা গল্প শুনতাম দাদার লজিংবাড়ি নিয়ে। দাদা সিলেটের প্রাচীনতম কওমি মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া হুসাইনিয়া ঢাকা উত্তর রানাপিংয়ে পড়াশোনা করেছেন। মাদরাসায় থাকতেন, লজিংবাড়ি গিয়ে খাবার খেতেন। একজন ঠেলাগাড়ির চালক খুব উৎসাহের সঙ্গে তাঁকে লজিং নিয়েছিলেন। আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না তাঁর। কিন্তু ঠেলাগাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন যে রোজগার করতেন, সেটা দিয়ে তাঁর পরিবারের সবার মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণ আহার জোগানোই মুশকিল হয়ে যেত। তারপরও তিনি একজন ‘তালেবে ইলম’-কে নিজেদের আহারসঙ্গী করতেন নিয়মিত। কেবল এই ঠেলাচালকই না, রানাপিংয়ের গরিব-ধনী সবার ঘরেই একজন করে তালেবে ইলমের আহারের বন্দোবস্ত থাকত। এটা যেন এলাকার একটা অঘোষিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তো ভদ্রলোকের ঘরে প্রতিদিন যে খাবার পাকানো হতো, সবাই ভাগ করে খেতেন। দাদার জন্যও থাকত সমান ভাগ। ভাতের সঙ্গে অল্প একটু তরকারি কিংবা ভর্তা। কিন্তু এই অল্প ভাত-তরকারি ‘মেছাব-বেটা’-কে কীভাবে দেবেন, এই চিন্তা করে লজিংয়ের গৃহকর্ত্রী মানে ঠেলাচালকের স্ত্রী প্রতি ওয়াক্তে একটি প্লেটে দাদার ভাগের ভাত-তরকারি দিতেন প্রথমে। দাদা ওই প্লেটে খেতে বসার পর আরও দুটি পাত্র নিয়ে আসতেন মহিলা। একটায় ভাত, আরেকটায় তরকারি। পাত্র দুটি দাদার সামনে রাখতেন। এই ভাত-তরকারি মূলত পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ভাগের। দাদার প্লেটের ভাত-তরকারি ফুরিয়ে যাবার আগে মহিলা বলতেন, ‘আহা, আমাদের মেছাবের ইলমে পেট ভরা, খান খুব অল্প! মেছাব বেটা, ভাত-তরকারি তো আর নেবেন না, তাহলে ওই পাত্রগুলো নিয়ে যাই?’

দাদা বুঝতে পারতেন পুরো ব্যাপারটা। তিনি পাত্রগুলো নিয়ে যেতে বলতেন। গৃহকর্ত্রীর এই অতি সহজ-সরল কৌশল তাঁকে ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ দিতো, একই সঙ্গে দরিদ্রতার মধ্যেও একজন তালেবে ইলমকে নিজেদের আহারসঙ্গী করার আন্তরিকতা আপ্লুতও করত।

আমার বাবা এবং তিন চাচার পড়াশোনাও লজিংবাড়িতে থেকে। মিজান থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত তাঁরা লজিংবাড়িতেই থেকেছেন। পরম্পরা জারি রাখতে কি না জানি না, শিক্ষাজীবনের প্রথম বেশ কয়েক বছর আমারও লজিংবাড়িতে থাকা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো—বাবা, তিন চাচা এবং আমি—আমাদের সকলের লজিং একই বাড়িতে ছিল। প্রথমে বাবা দীর্ঘ একটা সময় থেকেছেন, তারপর তিন চাচা, এবং সর্বশেষ আমি।

বাবা যখন ছিলেন, তখন এলাকার মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। সিলেটের জামিয়া গহরপুরের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা সবাই। শায়খুল হাদিস হজরত গহরপুরী রহমতুল্লাহি আলায়হির প্রভাব ও উৎসাহে দরিদ্রতা সত্ত্বেও গহরপুর এবং তৎপার্শ্ববর্তী আট-দশটা গ্রামের বাসিন্দা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের ঘরে একজন করে তালিবুল ইলমকে লজিং দিতেন। পরবর্তীতে কয়েক দশকের মধ্যে প্রবাস গমন এবং অন্য আরও নানাবিধ উপায়ে এই এলাকা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। এলাকার মানুষের অনেকের ভাষ্য, আল্লামা গহরপুরীর ‘দোআর কারণে’ তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন।

যাই হোক, যে পাড়াটায় আমরা লজিং ছিলাম, স্বাভাবিকভাবেই সে পাড়ার ঘরে ঘরে একসময় ছাত্রদের লজিং ছিল। ছাত্রদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল পাড়ার লোকজনের। আমি যে-সময় ছিলাম, তখন অবশ্যি আর ঘরে ঘরে লজিং ছিল না, তারপরও পাড়ায় আমরা যে কজন ছাত্র ছিলাম, আমাদের প্রতি পাড়ার লোকজনের স্নেহ ও সমীহ ছিল বিস্ময়কর। পরের বাড়িতে থাকি ‘আশ্রিত হিসেবে’—স্বাভাবিকভাবেই এই দৃষ্টিকোণটা যে কেউই লালন করার কথা ছিল, কিন্তু আমরা দেখেছি এর বিপরীতটা। আমাদেরকে তাঁরা পাড়ারই একজন বলে গণ্য করতেন। অবশ্যি সমস্যা যে হতো না, এমন না। মাঝে মাঝে কারও দ্বারা কোনো অসুন্দর আচরণের শিকার হতে হতো, কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাড়া বা মহল্লার মুরব্বিরা ছিলেন কঠোর। ছাত্রদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে রীতিমতো গ্রাম্য সালিশ বসে দোষীদের বিচার করার নজিরও আছে।

অনুরূপ সিলেটের জামিয়া রেঙ্গার কথা বলা যায়। খলিফায়ে মাদানি হজরত শায়খে রেঙ্গা রহমতুল্লাহি আলায়হির প্রভাবে রেঙ্গা এলাকার আশপাশের গ্রামগুলোতেও ঘরে ঘরে ছাত্রদের লজিং ছিল। আমার হিফজের উসতাদ, যিনি রেঙ্গা মাদরাসায় পড়েছেন লজিংয়ে থেকে, তাঁর মুখে শুনেছি, বাবার মুখেও শুনেছি, আগেকার লজিংয়ে থাকা ছাত্রদের প্রভাব এবং জৌলুশের গল্প।

এককালে গহরপুর ও রেঙ্গার আশপাশের এলাকায় প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে একটি করে বাংলোঘর থাকত। এটা বানানোই হতো মাদরাসার ছাত্রদের লজিং দেওয়ার জন্য। যার বাংলোঘর থাকত না, সে প্রতিবেশীর বাংলোঘরে নিজের তালিবুল ইলমকে থাকার বন্দোবস্ত করে দিত।

গহরপুর এবং রেঙ্গা মাদরাসা পাশাপাশি দুটো উপজেলায় অবস্থিত। একসময় পায়ে-হাঁটা-পথে যাতায়াত করা যেত এক মাদরাসা থেকে আরেক মাদরাসায়। উভয় মাদরাসার লজিংয়ে থাকা ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক একটা যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগ থেকে মাঝেমাঝেই দুই পক্ষ মিলে মুশায়েরার আয়োজন করত। মুশায়েরা হচ্ছে ফার্সি ও উর্দু শের পাঠের আসর। কখনো কখনো বাংলায় শের পড়া হতো। তবে সেটা উপস্থিত বানিয়ে বানিয়ে বলতে হতো। বিভিন্নভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। লজিংয়ে থাকা ছাত্ররাই করত। আয়োজন-সহযোগিতায় থাকতেন গ্রামের মাতব্বর গোছের লোকেরা। রাতের বেলা গহরপুর বা রেঙ্গা এলাকার কোনো বাড়িতে মাদরাসার উসতাদদের অগোচরে বসত এইসব আসর।

বাড়িওয়ালা কখনো খাসি, কখনো গরু, কখনো মোরগ—যার যার তৌফিক আন্দাজা খাবার-দাবারের আয়োজন করতেন। মুশায়েরায় দুটো পক্ষ থাকত। কখনো গহরপুর ও রেঙ্গা—দুই মাদরাসার ছাত্র থাকত দুই পক্ষে। আবার কখনো দুই গ্রামে লজিং-থাকা একই মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে হতো লড়াই। রাতভর চলত শের চালাচালি। এক পক্ষ কোনো একটা শেরের কিয়দাংশ আবৃত্তি করত, সেই আবৃত্তির একদম শেষের অক্ষর দিয়ে অপর পক্ষ অন্য কোনো শের শুরু করতে হতো। এটার ওপরই নির্ভর করত হার-জিত। আবার কখনো কখনো বাংলায় উপস্থিত-শের বানিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করত।

লজিংবাড়িটা ছাত্রদের জন্য নিজের বাড়ির মতোই ছিল অনেকটা। একেকজন ছাত্র একেকটা বাড়িতে সাত-আট বছর/দশ বছর পর্যন্তও লজিং থাকত। অসম্ভব রকমের একটা মায়া জন্মে যেত পরস্পরের মধ্যে। আমরা যদিও মুশায়েরা বা এই রকমের আনন্দ-আয়োজন পাইনি, কিন্তু লজিংবাড়ির মানুষের স্নেহ-মমতায় ঠিকই আপ্লুত হয়েছি।

সেই সময় এখন আর নেই। প্রচণ্ড অন্তর্মুখিতা কিংবা আরও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে মানুষ এখন লজিং দিতে চায় না। আবার মাদরাসা-কর্তৃপক্ষও ছাত্রদের বিশেষ নেগরানিতে পড়াশোনা করানোর জন্য বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। উসতাদরা এখন আর ছাত্রদের লজিংয়ে রাখতে আগ্রহী নন। তারপরও গহরপুর এবং রেঙ্গায় এখনও প্রচুর ছাত্রের লজিং আছে। তবে এই প্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে মুশায়েরার মতো মজাদার একটা কাব্যচর্চার আসরও হারিয়ে গেছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো এই আয়োজনের নামই শুনতে পাবে না কখনো।

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!