সিলেটে তারুণ্যের মাহফিল করে প্রশংসায় ভাসছে ‘সৃজনঘর’

সৃজনঘর তারুণ্যের মাহফিল ২০২২

শীলিত সৃজনের ছায়ানীড় সৃজনঘরের সাড়া জাগানো আয়োজন ‘সৃজনঘর তারুণ্যের মাহফিল ২০২২’ হাজারও তরুণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের ব্যতিক্রমধর্মী এই আয়োজনটি সম্পন্ন হয় সিলেট মহানগরীর আমান উল্লাহ কনভেনশন সেন্টারে। তরুণ শ্রেণির এক হাজার রেজিস্টার্ড ডেলিগেটের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এতে প্রশিক্ষণধর্মী আলোচনা রাখেন দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলাররা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উলামা-মাশায়েখ ব্যবসায়ী সমাজসেবী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। দিনভর তারুণ্যের মাহফিল করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছে সংগঠনটি।

সৃজনঘরের দুই সহযোগী সদস্য মাওলানা সৈয়দ আসিফ ও মুফতি আবু সুফিয়ান নাসিমের তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া তরুণদের জন্য বিশেষায়িত তিন পর্বের এই অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল টকশো। পাঁচ তরুণ লেখক-চিন্তকের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত টকশোর আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ইসলামি সংস্কৃতি: বাঙালি মুসলিম তরুণদের চিন্তা’। লেখক-সাংবাদিক বাশিরুল আমিনের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন তরুণ কথাসাহিত্যিক মাওলানা সাবের চৌধুরী, প্রাবন্ধিক মাওলানা সাদিকুর রাহমান, তরুণ কবি মুফতি মুহাম্মাদ রাইহান, লেখক-অ্যক্টিভিস্ট মাওলানা ফারুক ফেরদৌস। সকাল ৯টা ২০ থেকে ১০টা ৩০ পর্যন্ত ছিল টকশো পর্বের ব্যাপ্তি।

দ্বিতীয় পর্বে ছিল তামাদ্দুন ওয়ার্কশপ। ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর স্বতন্ত্র সাত বিষয়ে প্রশিক্ষণধর্মী আলোচনা করেন বরেণ্য সাত ইসলামিক স্কলার। ‘তাওহিদভিত্তিক একতা: মাসলাক-ঊর্ধ্ব স্বার্থচিন্তার প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ে আলোচনা করেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। ‘কুরআনের মূলপাঠ ও তাদাব্বুর: দূরত্ব গোছানোর তরিকা’ বিষয়ে আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার। ‘অধুনা সময়ে কেমন হবে একজন মুসলিম তরুণের জীবনাচার’ বিষয়ে আলোচনা করেন বরেণ্য আলেম কথাসাহিত্যিক মাওলানা মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন। ‘সিরাত: ইতিবাচক পরিবর্তনের সৌন্দর্য’ বিষয়ে আলোচনা করেন বরেণ্য আলেম কথাসাহিত্যিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ। ‘অধুনা সময়ে ইসলামের দাওয়াহ : পদ্ধতি ও কৌশল’ বিষয়ে আলোচনা করেন বরেণ্য দাঈ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমাদুল্লাহ। ‘হাজার বছরের মুসলিম সংস্কৃতি: বৈশিষ্ট্য ও আজকের তারুণ্য’ বিষয়ে আলোচনা করেন বহুমুখী লেখক ও গবেষক মাওলানা মুসা আল হাফিজ। ‘আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামি অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ’ বিষয়ে আলোচনা করেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ আলেম মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম। সকাল ১০টা ৩০ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ছিল তামাদ্দুন ওয়ার্কশপের ব্যাপ্তি। অডিয়েন্সের হৃদয়ঙ্গমতা যাচাইয়ের জন্য প্রত্যেক আলোচকের আলোচনা শেষে ছিল পাঁচ মিনিট ব্যাপ্তির ‘ঝটপট প্রশ্ন ঝটপট উত্তর’। এ ছাড়াও ওয়ার্কশপ শেষে পুরো ওয়ার্কশপজুড়ে অডিয়েন্সের হৃদয়ঙ্গমতা যাচাইয়ের জন্য ছিল লিখিত পদ্ধতিতে ‘টেন মিনিট এক্সাম’-এর আয়োজন। উভয় পরীক্ষাতেই বিজয়ীদের দেওয়া হয় আকর্ষণীয় পুরস্কার।

তৃতীয় পর্বে ছিল কাওয়ালি জলসা। ঐতিহ্যবাহী সুফিধারার বিশেষায়িত সংগীত যৌথভাবে পরিবেশন করেন জনপ্রিয় নাশিদশিল্পী আহমদ আবদুল্লাহ, শালিন আহমদ, শেখ এনাম ও শাহেদ নিজাম। তাঁদের সঙ্গে কোরাসে ছিলেন নবীন আরও একাধিক নাশিদগায়ক। রাত ১০ টায় বরুণা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শেখ বদরুল আলম হামিদীর আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ১৩ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের প্রশিক্ষণধর্মী ও উৎসবমুখর এ আয়োজন।

মাহফিলে সকাল ৯টা থেকেই ডেলিগেটদের হল ভর্তি উপস্থিতি ছিল। রাত ১০টা পর্যন্ত সে উপস্থিতি নিরবচ্ছিন্নভাবে অবশিষ্ট ছিল। অনুষ্ঠানের পুরো সময়জুড়ে উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা মীম সুফিয়ান ও মুফতি মুহাম্মাদ রাইহান।

এ ছাড়া তামাদ্দুন ওয়ার্কশপের সাত আলোচকের প্রস্তুতকৃত আলোচ্য সাত বিষয়ের কিনোট পেপারের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘সৃজনঘর তারুণ্যের মাহফিল ২০২২ স্মারক’ ম্যাগাজিন। সৃজনঘরের সাধারণ সম্পাদক হামমাদ রাগিবের রচনায় মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়পূর্ব বাংলা ভূখণ্ডের সমাজবাস্তবতা ও ইসলামপ্রচারের গল্পভাষ্য গ্রন্থ ‘প্রাচীন বাংলার দরবেশ’-এর আনুষ্ঠানিক মোড়কও উন্মোচিত হয় তামাদ্দুন ওয়ার্কশপের শুরুর অংশে। মাওলানা মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন ও মাওলানা মুসা আল হাফিজ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

পুরো আয়োজন সম্পর্কে সৃজনঘরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হামমাদ রাগিব বলেন, ‘অনুষ্ঠানটি বিশেষায়িতভাবে বাঙালি মুসলিম তরুণ শ্রেণির উপযোগী করে আমরা আয়োজন করার চেষ্টা করেছি। ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূলবোধ বিষয়ে যেন তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। যেন একটি আত্মজিজ্ঞাসা জেগে ওঠে তাঁদের ভেতরে। তরুণরা নিজেকে নিজে যেন প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্নের রসদ যেন জোগাড় করে নিতে পারেন দিনব্যাপী আয়োজনের বিভিন্ন ভাঁজ থেকে। যেন নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ও করণীয় সম্পর্কে আরও একবার হয়ে উঠতে পারেন সজাগ সচেতন।’

আয়োজনের প্রতি তরুণ শ্রেণির আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস প্রসঙ্গে সৃজনঘরের সভাপতি মাওলানা সাইফ রাহমান বলেন, ‘প্রোগ্রামের নির্ধারিত তারিখের ঠিক একমাস আগে তারুণ্যের মাহফিল যে হচ্ছে সে বিষয়ে অফিসিয়াল ঘোষণাটি আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করি। তারপর বিস্তারিত শিডিউল প্রকাশের আগেই কেবল ‘তারুণ্যের মাহফিল’ নামটি দেখে শতাধিক তরুণ নিজেদের রেজিস্ট্রেশন কনফার্ম করে ফেলেন। রেজিস্ট্রেশনের শেষ তারিখ ছিল ২০ আগস্ট, কিন্তু আমরা যখন বিস্তারিত শিডিউল প্রকাশ করি, এত বিপুল সাড়া পড়ে যে, ৭ আগস্টের মধ্যেই আমাদের সবগুলো আসন ফিলাপ হয়ে যায়। প্রোগ্রামের ভেন্যু সিলেট হলেও ঢাকা-চট্রগ্রাম খুলনা-রাজশাহী বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগ্রহী তরুণরা অংশগ্রহণ করেন। সিট ফিলাপ হয়ে যাওয়ায় ৭ আগস্ট আমরা রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই, কিন্তু তারপর থেকে প্রোগ্রামের দিন পর্যন্ত ফোনকলে, ম্যাসেজে, বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে ভায়া ধরে আমাদের কাছে অজস্র অনুরোধ এসেছে একটি আসন দেওয়ার জন্য, আমরা দিতে পারিনি।’

তারুণ্যের মাহফিলের প্রতি তরুণদের এত আগ্রহের পেছনে কী কারণ জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হামমাদ রাগিব বলেন, ‘সেমিনারধর্মী প্রোগ্রাম তো সচরাচর হয়ই, কিন্তু সেমিনারের যে ধাঁচ ও ধারা, তা খুব কম জায়গায় অনুসরণ করা হয়। ফলে আমাদের আশপাশে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার থেকে অডিয়েন্স আশানুরূপ উপকৃত হতে পারে না। আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে প্রশিক্ষণের একটা আমেজ রাখার চেষ্টা করেছি আমাদের আয়োজনে। পাশাপাশি ভারী ভারী আলোচনায় যাতে বিরক্তি ও অনাগ্রহ তৈরি না হয়, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে চেয়েছি। আলোচ্য বিষয় বাছাই ও আলোচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতা বিধান, তরুণদের উপকৃতি, আগ্রহ ও প্রয়োজনের দিকটিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছি। সম্ভবত এসব বিষয় তরুণদের পছন্দ হয়েছে। ফলে তাঁরা এই উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ দেখিয়েছেন।’

অনুষ্ঠানের সমাপ্তি প্রসঙ্গে সৃজনঘর সভাপতি মাওলানা সাইফ রাহমান বলেন, ‘সৃজনঘর তারুণ্যের মাহফিলে আগত সবাইকে আন্তরিক মুবারকবাদ ও শুকরিয়া। যে যেভাবে আমাদেরকে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন, সবার প্রতি সৃজনঘর পরিবার কৃতজ্ঞ। তারুণ্যের মাহফিলে আমাদের অপরিপক্কতার জন্য অনেক মিস্টেক হয়েছে, পাশাপাশি শৃঙ্খলার স্বার্থে অনেক কঠোরতাও অবলম্বন করতে হয়েছে। সেজন্যে সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহ তাআলা আমাদের ভালো কাজগুলো যেন কবুল করেন, ভুলত্রুটি যেন ক্ষমা করেন, আমিন।’

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!