সীরাতপাঠ: কেন পড়বেন কী পড়বেন কীভাবে পড়বেন

মাওলানা মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন

সীরাত কী

সীরাত। সীরাতুন্নবী। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিশ্বাসের আতরমাখা এক মন্ত্রময় শব্দ। এই শব্দ আমাদের আবেগের দরিয়া, আস্থার হিমালয়, বিশ্বাসের আলোকমিনার এবং জীবনচলার সরল পথ। এই একটি শব্দের মধ্যে জেগে আছে আমাদের মুক্তির সফল অব্যর্থ বার্তা; পথ চলার লক্ষ-কোটি দীপক পূর্ণিমা। এই একটি শব্দে সঞ্চিত আছে মক্কা মুকাররমার সবচাইতে মোহন অধ্যায়; পাক মদীনার সুরভিত জন্মকাহিনি; মানব ও মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, কাওসার ও প্রশংসিত মাকামের অধিপতি, শাফায়েতের কাণ্ডারী, সকল নবীর ইমাম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অমর অব্যয় জীবনালেখ্য।

মানি, শাস্ত্রের ভাষায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত ও পরিচালিত যুদ্ধ জিহাদের ঘটনাবলিকেই বলা হতো সীরাতুন্নবী। কারও কারও ভাষায় প্রাচীন যুগে ইলমুস সিয়ার ও ইলমুল মাগাযীকে বলা হতো সীরাতুন্নবী। পরে সীরাতের পরিভাষা বিস্তৃতি লাভ করেছে। মুসলিম উম্মাহর প্রাণের প্রাণ প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যসত্তা, জোছনাময় গুণাবলি, অজর অক্ষয় কর্মমালা; তাঁর সহচরগণের চারিত্রিক ও আর্দশিক নির্মাণ, তাঁদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য, মুক্তির শাশ্বত জীবনবিধান, পবিত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর কর্মপদ্ধতির সামগ্রিক রূপকেই সীরাত বলা হয়। কেউ কেউ আবার এই কথাটাকেই সহজ করার জন্যে বলেছেন-হাদীস শরীফের বিশাল ভাণ্ডারকেই সীরাতুন্নবী বলা হয়। তাই তাঁর যুদ্ধজিহাদ, আদব-শিষ্টাচার, তাফসীর-আকাইদ, কেয়ামতের আলামত, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত ফেতনার বিবরণ, জীবনযাপনের বিধি-বিধান এবং তাঁর ও তাঁর সঙ্গীবর্গের মহৎ গুণাবলির বর্ণনা-সবই পবিত্র সীরাতের অংশ।

কেন পড়বেন

এক.
এক কথায় যদি বলি তাহলে বলব-সীরাত পড়ব আমার জীবনকে সুন্দর সুশৃঙ্খল মোহন নন্দিত কর্মচঞ্চল ও অমর অব্যয় করে গড়ে তোলার জন্যে। সৃষ্টি ও স্রষ্টা-সকলের চোখে চিরআকাক্সিক্ষত হয়ে ওঠার যে বাসনা লালন করে সতর্ক সচেতন স্বাপ্নিকমাত্রই-সীরাতুন্নবী ওই সুপ্ত গুপ্ত মহতি স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার পথ। এই পথ অব্যর্থ, এই পথ অবারিত এবং এই পথ আলোর পাথরে বাঁধানো!

যদি খানিকটা ব্যাখ্যা করে বলি কেন পড়ব আমরা সীরাতন্নবী-আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে- তাহলে বলব, এ আমাদের মালিকের অকাট্য আদেশ! আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ ও রাসূলের। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রেখো-আল্লাহ কাফেরকে পছন্দ করেন না।’ [আলে ইমরান, আয়াত-ক্রম : ৩২] বলেছেন : তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো-যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।’ [আলে ইমরান, আয়াত-ক্রম : ১৩২] সূরা আহযাবের বাণীটি আরও দ্ব্যর্থহীন। বলেছেন : ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে আশাবাদী-বিশ্বনবী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে-তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আর্দশ।’ [আহযাব, আয়াত-ক্রম : ৩৩]

ঈমানদারমাত্রই বিশ্বাস করেন, দয়াময়ের দয়া করুণা কৃপা ছাড়া আমাদের জীবন অচল অন্ধ বন্ধ্যা। আর ওই রহম কৃপা ও করুণার পথ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ওই পথই আর্দশ। জীবনের সফলতা বিজয় ও প্রতিষ্ঠা নিহিত ওই করিত পথে। ওই পথকে জানা ছাড়া সৃষ্টি ও স্রষ্টার চোখে পূর্ণ সফল জীবন নির্মাণ করা সম্ভব না কারও পক্ষে। সীরাতপাঠের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব এটা! আরও সহজ করে বললে শরণ নিতে হয় এই শাশ্বত মধুময় আদেশের-‘(হে রাসূল!) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [আলে ইমরান, আয়াত-ক্রম : ৩১]

আমরা জানি ‘সরণ’ অর্থ পথ। কারও পথ ধরে চলাই অনুসরণ। আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল অন্যয় অপরাধ ও পাপের কলঙ্ক-মুক্তি এবং তাঁর ভালোবাসা লাভের পথ হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই কেউ যদি পাপমুক্তি চায়, চায় আল্লাহর ভালোবাসায় সিক্ত তৃপ্ত ধন্য হতে-তাকে জানতেই হবে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনধারা! সীরাতগ্রন্থ পাঠই যার একমাত্র পথ। সীরাত-অঙ্কিত পথ জানা নেই যার, পড়া নেই যার-কোথায় খুঁজবে সে স্রষ্টার ক্ষমার বর্ষণ আর ভালোবাসার পুস্পমদিরা!

দুই.
বিদ্বজ্জনরা ভালো করেই জানেন, আমাদের প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সভ্য পৃথিবীর এক উন্মুক্ত পাঠশালা। যারা তাঁকে নবী হিসেবে মানতে পারেনি, পারছে না, পারবে নাÑতারাও তাঁকে পড়েছে, পড়ছে এবং পড়বে পার্থিব জীবনের আকাক্সিক্ষত বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার স্বার্থে! কারণ, তিনি পার্থিব বিচারেও আকাক্সিক্ষত সকল শুভ গুণের অনুপম ছবি। কী পরিবার, কী সমাজ, কী দেশ আর কী কালোর্ত্তীণ বিশ্বসভা-যে কোনো ক্ষেত্রে আপন প্রতিভার মার্জিতপূর্ণ বিকাশ যদি কেউ চায়-আমাদের নবীজির জীবনে রয়েছে তার জন্যে উত্তম আর্দশ ও অনুকরণীয় পথরেখা। যদি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই বলতে পারি-একজন ব্যক্তিকে তার কাছের এবং দূরের, চেনা এবং অচেনা-সকলের কাছে প্রার্থিত ও আকাক্সিক্ষত করে তুলে তার ভাষা পোশাক ও আচরণ। এইসব বিবেচনায় তাঁর জীবন ছিল শিল্পের নিপুণ চিত্র। তাঁর মাতৃভাষায় তাঁর অধিকার ছিল উপমেয়। কী কথাবলা, কী ভাষণ-বক্তৃতা আর কী একান্ত শলা-পরামর্শ-সবখানেই উপযুক্ত শব্দ, আর্কষণ উপমা, বাক্যের ঋজু গড়ন, ভাষার প্রাঞ্জল্য আর হৃদয়জাত উচ্চারণ ও নিখাদ নির্মল আবেগের মিশেল-শত্রুমিত্র সবাইকেই আলোড়িত ভাবান্তারিত এবং তাঁর সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সমর্পিত করে তুলত। তাই এখনও যদি কেউ নিজেকে ভাষামন্ত্রের এই মোহন শিল্পে শানাতে চায়-পরম আস্থায় সে হাতে তুলে নিতে পারে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতগ্রন্থ।

আমাদের সমাজে কেবল নয়-পোশাকে ব্যক্তির প্রথম পরিচয়-কথাটি সব কালেই সব দেশেই মানিত। কেউ যদি সরল সুন্দর অভিজাত পোশাকে নিজেকে পুত-দুরস্ত করে সাজাতে চায়-ওই পাথেয়ও আছে তাঁর সীরাতে। তাঁর খানাপিনা ওঠাবসা হাঁটাচলা হাসি-কান্না ক্রোধ-যেন মার্জিত কবিতার একেকটি পঙক্তি! কী ঘরে কী বাইরে, কী পরিবারে, কী বন্ধুমহলে সরল অথচ মার্জিত চুম্বক চরিত্রের যে ছন্দ ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের হরফে হরফে-ব্যক্তিত্বপূর্ণ মার্জিত জীবন নির্মাণে স্বাপ্নিকের জন্যে এরচেয়ে সুন্দর নিখুঁত ও উজ্জ্বল উপমা আর কোথায়?

শূন্য থেকে একটি রাষ্ট্র রচনা করেছিলেন অবিশ্বাস্য শৃঙ্খলায়। চরম অভাবে ছিল যাদের ইতিহাস-তাদের ঘরে স্বচ্ছলতা এসেছিল তাঁর হাত ধরে। ছোট-বড় আর উঁচু-নিচু শব্দগুলো হারিয়ে গিয়েছিল চর্চিত মানবতা আর প্রতিষ্ঠিত ইনসাফের স্রোতে। রাষ্ট্রপ্রধান পৃথিবীর ইতিহাসে বহুল উচ্চারিত একটি প্রাত্যহিক ‘শব্দ-বন্ধ’ হলেও হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরশে এসে জেগে ওঠে অবিশ্বাস্য উচ্চতায়। কেউ যদি আজও ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ এর কুরসিতে বসে ওই উচ্চতায় অভিসিক্ত হতে চায়Ñ তাকে অবশ্যই পাঠ করতে হবে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে!

ভালো ভাই হতে চাইলে; ভালো বন্ধু হতে চাইলে; ভালো অভিভাবক হতে চাইলে; অবিসংবাদিত শালিস হতে চাইলে কিংবা বিচারক হতে চাইলে; চোখের ইশারায় জীবন দিতে কুণ্ঠাহীন নেমে আসে-এমন সৈন্যবাহিনীর সিপাহসালার হতে চাইলে; সত্য সুন্দর ও আদর্শের আপসহীন সৈনিক নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পাঠশালার চিরসফল শিক্ষক হতে চাইলে-তাঁর সর্বোত্তম উপমা তো হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই। তাই তাঁকে পড়তেই হবে।

তাঁকে পড়তে হবে সোহাগপ্রিয় জীবনসঙ্গিনীর অকৃত্রিম ভালোবাসা পেতে চাইলে। নিটোল শ্রদ্ধায় বরিত পিতার আসন চাই? কিংবা বিশ্বাস শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রশ্নাতীত শ্বশুর হতে? কী চাই-সম্মান মমতা প্রেম ভালোবাসা ও মান্যতার সুবাদে? মানবজীবনের আকাঙ্ক্ষিত সকল গুণ বিশেষণ অভিধা তাঁর জীবনছোঁয়ায়; তাঁর অতুল পরিচয়টায় এমন এক বিকশিত প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে-পৃথিবীর কোনো বিদ্বান সচেতন স্বাপ্নিক ব্যক্তি যদি বিশিষ্ট কোনো গুণ চরিত্র ও বিশেষণে অমর হয়ে থাকতে চায়-তার মন্ত্রণা জানার শ্রেষ্ঠতম বিশ্বস্ত পাঠশালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই বিচারে তিনি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্যে অবশ্য-পাঠ্য। বহুমুখী স্বার্থক সফল মোহন জীবনের বহুবিচিত্র এবং দৃশ্যত পরস্পর বিপরীত অব্যর্থ সব চুম্বক উপদানে প্রণীত এক অমৃত ধারা তাঁর জীবন। এ জীবন-পাঠশালা শত্রু-মিত্র সকলের জন্যে সদা অবারিত। তাই পার্থিব-জীবনের যে কোনো সফলতার পাথেয়-প্রত্যাশীও অবগাহন করতে পারেন এই অমৃত সরোবরে; হাঁটু পেতে শিষ্য হতে পারেন এই স্বর্ণপ্রসবিণী পাঠশালায়!

কী পড়বেন

এক.
আমরা যদি স্বীকার করে নিই-জীবন ও শিক্ষা-দুটো মিলেই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত-তাহলে মানতেই হবে আল-কুরআনুল কারীম এবং হাদীসের গ্রন্থাবলিই সীরাতুন্নবীর সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস। তাই কেউ যদি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে তার প্রথম ও প্রধান পাঠ্য হবে কুরআন এবং হাদীস। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আমি তো উত্তম-চরিত্রের পূর্ণতাবিধানের লক্ষ্যেই প্রেরিত হয়েছি। যখন আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তাঁর আখলাক ও চরিত্র সম্পর্কে, তিনি তার জবাবে বলেছেন, তাঁর চরিত্র ছিল আল-কুরআন।

তাই যে শিক্ষা আর্দশ চরিত্র ও শিষ্টাচারের বিত্রিত ছবি তাঁর অনুপম জীবনচরিত ওই শিক্ষা আদর্শ চরিত ও শিষ্টাচারের সর্বাধিক শুদ্ধ শক্ত ও দীপক উৎস কুরআন-হাদীসকেই মানতে হবে নবী-জীবনের প্রধান উৎস।

এ ক্ষেত্রে বরিত ইমামগণের তাফসীরসহ পবিত্র কুরআনের ধ্যানমগ্ন পাঠ প্রথম কর্তব্য। তারপর ইমাম মালিক রহ. (ওফাত : ১৭৯ হি.)-এর মুয়াত্তা শরীফ থেকে হাফেজ আলী ইবনে আবু বকরা হায়সামী (ওফাত : ৮০৭ হি.) এবং শায়েখ আলী আল মুত্তাকীর (ওফাত : ৯৭৫ হি.) কানযুল উম্মালসহ বরিত মুহাদ্দিসগণের সকল গ্রন্থই পাঠ্য।

তারপরও সহজে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ শিক্ষা ও নবীজি আনীত জীবনদর্শন জানতে ও আত্মস্থ করতে আমরা তিনটি গ্রন্থ সদা টেবিলে রাখতে পারি। যথা-

এক. ইমাম বুখারী রহ. (ওফাত : ২৫৬ হি.) সংকলিত ‘আলআদাবুল মুফরাদ-অনবদ্য শিষ্টাচার’ গ্রন্থটি। আকারে অনেক বড় না। ১৩২২টি হাদীস সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে, কিন্তু মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার বিস্তার ও গভীরতা, ব্যাপ্তি ও পূর্ণতা এবং সরলতা ও জীবন-ঘনিষ্ঠতার এক অবারিত পাঠশালা এই গ্রন্থ!

দুই. ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যাহ রহ.-এর ‘যাদুল মায়াদ’। পুরো গ্রন্থের নাম ‘যাদুল মায়াদ ফী হাদয়ি খায়রিল ইবাদ’। ওহীর যে জোছনামাখা পথরেখা এবং চিরআলোকিত ও অব্যর্থ সফলতার যে নূরোজ্জ্বল পাথেয় নিয়ে এই মাটির পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সবিস্তার বিবরণ আছে এই গ্রন্থে। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে-মতো যাকে খুশি নির্বাচন করেন-থেকে গ্রন্থের সূচক। গ্রন্থের প্রথমভাগেই আছে-নবীজি হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নসব ও বংশ পরম্পরা বিবরণ, তাঁর মা-বাবার বর্ণনা; তাঁর বেড়ে-ওঠা; তাঁর দুধ মাতাদের কথা; প্রথম অবর্তীণ ওহীর কথা; স্ত্রী সন্তান চাচা ফুপু দাস-দাসী, সেবক, সেক্রেটারি, প্রতিনিধি ও প্রহরীদের বিবরণ থেকে শুরু করে নখকাটা গোফ ছাটা খানাপিনা হাসি-কান্নাসহ ইবাদত-বন্দেগীর বিস্তৃত বিবরণ। প্রিয়তম নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর নবী, পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শনের শিক্ষক ও মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার হিসেবে চেনা যায় এই গ্রন্থে।

অবশ্য গ্রন্থ পাঠ করার সময় মনে রাখলে সুবিধা হবে-লেখক আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যাহ রহ. আল্লামা ইবনে তায়মিয়ার শিষ্য এবং তিনি হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী।

তিন. হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ. (ওফাত : ১১৭৬ হি.) রচিত জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ।’ এই গ্রন্থে ধর্ম ও ধর্মের বিধিবিধানের পারস্পরিক সর্ম্পক ও তার অন্তর্নিহিত দর্শন বিবৃত হয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ বর্ণনায়। ঈমান, ইবাদত, লেনদেন, আখলাক, সমাজ-দর্শন, সভ্যতা, সংহতি, রাজনীতি ও তাসাওফ পত্রস্থ হয়েছে। যথার্থ মর্যাদায় মান গুরুত্ব ও ফলাফল বিচারের তালাকে। পৃথিবীখ্যাত মনীষী মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর ভাষায়-‘আমাদের জানা মতে পৃথিবীর কোনো ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এমন কোনো বই আজ পর্যন্ত লিখিত হয়নি। আর যদি হয়ে থাকে-তাহলে সেটা এখন পৃথিবীর সামনে নেই।’

দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে আমাদের প্রিয় উস্তাদ হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.-এর তাহকীক ও তালীকসহ। মনে রাখলে ভালো হবে, ইংরেজ-পরবর্তী পৃথিবীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামকে বিশ্লেষণের এক নতুন দর্শন আবিস্কার করেন হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ.। সৃষ্টি করেন অনেক নতুন পরিভাষা। ওইসব পরিভাষার মর্মোদ্ধারে সক্ষমদের জন্যে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার আরবী সংস্করণ উত্তম উপহার। আর যাঁদের পক্ষে ওইসব পরিভাষায় মর্মোদ্ধারে সম্ভব না আবার তিনি হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ.-এর হাত ধরে ডুব দিতে চান ইসলামের অতলস্পর্শী দর্শনের গভীরে-তাঁদের জন্যে অনিবার্য-পাঠ্য ‘রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়াহ’। সমকালীন বিশে^র খ্যাতিমান মুহাদ্দিস দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.। দারুল ঊলূম দেওবন্দের বরিত শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসিন এই বিদগ্ধ জ্ঞানপুরুষ পাঁচ খণ্ডের এই ভাষ্যগ্রন্থে ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শের দার্শনিক বিশ্লেষণে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা এক কথায় অনন্য। এই সময়কার স্বাপ্নিক ও পাঠমনস্ক তরুণ আলেমদের জন্যে এরচে’ মূল্যবান আর কোনো উপহার হতে পারে বলে মনে হয় না।

দুই.
হাদীস শরীফ থেকে আলাদা হয়ে সীরাতুন্নবী স্বতন্ত্র শাস্ত্ররূপে দাঁড়াতে শুরু করে সম্মানিত তাবিঈনের কালেই। যখন থেকে উন্মুক্ত উঞ্চতায় হাদীস সংকলন শুরু হয় তখন থেকেই নবীজির জন্ম দুধপান অতঃপর নবুওয়াত মক্কায় যাপিত দাওয়াতিজীবন; প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর ও তাঁর সাথিবর্গের অনুপম বিসর্জন, ধৈর্য, হিজরত এবং যুদ্ধজিহাদের বিবরণ পত্রস্থ হয় স্বতন্ত্র অধ্যায়ে।

তাঁর জীবন-মাধুরিমার প্রথম কালের লেখকদের মধ্যে আছেনÑওরওয়া ইবনুয যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (৯২ হি.); আবান ইবনে উসমান (১০৫ হি.); ওহাব ইবনুল মুনাববিহ (১১০ হি.) শুরাহবীল ইবনে সা’দ (১২৩ হি.); ইবনে শিহাব যুহরী (১২৪ হি.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ইবনে হাযম (১৩৫ হি.) রাহিমাহুমুল্লাহু তায়ালা। তবে তাঁদের ওইসব রচনা ও সংকলন স্বতন্ত্ররূপে সংরক্ষিত হয়নি। অবশ্য তার কিয়দাংশ ইতিহাস-গ্রন্থের পাতায় পাতায় ইতস্ততরূপে সংরক্ষিত হয়েছে।

এঁদের পর যাঁরা সীরাত সংকলনে প্রয়াসী হন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, মুসা ইবনে ওকবা (১৪১ হি.), মা’মার ইবনে রাশেদ (১৫০ হি.) এবং ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রহ. (১৫২ হি.) প্রমুখ।

তাঁদের পর যাঁরা নবীজির সীরাত রচনা ও সংকলনের মহতি পত্রে নাম লিখিয়েছেনÑতাঁদের মধ্যে মাগাজিবেত্তা ইমাম ওয়াকেদী ২০৭ হি.) ইবনে হিশাম (২১৮ হি.) এবং আততাবাকাত-এর লেখক মুহাম্মদ ইবনে সাদ রহ. (২৩০ হি.) জগদ্বিখ্যাত।

তিন.
এ ছিল স্বতন্ত্র শাস্ত্রের সূচনা ও ক্রমবিকাশের ধারা। অবশ্য হাদীস-সংকলক ও সীরাতকারদের মধ্যে চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্যও আছে। তাই যারা সরাসরি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানতে চায় তাদের জন্যে সীরাতপাঠই পরম তৃপ্তিদায়ক। আমরা এখানে সীরাতের উৎসগ্রন্থরূপে সর্বজন মানিত ও বিদিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি।

এক. সীরাতে ইবনে ইসহাক রহ. (ওফাত : ১৫২ হি.)। ইসলামের যুদ্ধ-জিহাদ-সীরাতুন্নবীর প্রধান উপাত্ত। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক এ বিষয়ে বরিত ইমাম। আমাদের বাংলাভাষায় বহুপূর্বে অনূদিত এই গ্রন্থটির মূল আরবী সংস্করণ এখন দুর্লভ। অবশ্য এটি সীরাতে ইবনে হিশামে পূর্ণ যত্নে সংরক্ষিত ও সংকলিত হওয়ায় গবেষকগণ আর মূল গ্রন্থ খোঁজেন না।

দুই. ইমাম ওয়াকেদী রহ. সংকলিত ‘আল-মাগাযী’। ওয়াকেদী রহ. (ওফাত : ২০৭ হি.) সিয়ার ও মাগাযী বিষয়ে শীর্ষ ব্যক্তি। দারাওয়ারদী রহ. তাঁকে ‘আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস’ বলেছেন। এটি সীরাতুন্নবীর প্রাচীন উৎসগ্রন্থরূপে বরিত।

তিন. সীরাতে ইবনে হিশাম। গ্রন্থের মূল নাম : আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ। লেখক আবদুল মালিক ইবনে হিশাম (ওফাত : ২১৩ হি.)। চারখণ্ড, দুই ভলিয়মে সমাপ্ত। এটা সীরাতে ইবনে ইসহাকের পরিমার্জিত সংকলন। সঙ্গে আছে ইবনে হিশাম রহ.-এর ভাষ্য ও বিশ্লেষণ। পৃথিবীব্যাপী সীরাত-গবেষকদের কাছে সীরাতুন্নবীর শ্রেষ্ঠ উৎসগ্রন্থরূপে সমাদৃত। এই গ্রন্থ সম্পর্কে ইবনে খাল্লিকান রহ. বলেছেন-ইবনে ইসহাকের মাগাযী ও সিয়ার বিষয়ক সংকলনটি নতুনভাবে সংকলন ও পরিমার্জন করেছেন। কোথাও সংক্ষেপ করেছেন, কোথাও করেছেন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আর এটাই এখন সকলের কাছে সীরাতে ইবনে হিশাম নামে বিখ্যাত।

চার. তাবাকাতে ইবনে সা’দ। মূলগ্রন্থের নাম : আত-তাবকাতুল কুবরা। লেখক মুহাম্মদ ইবনে সা’দ রহ. (ওফাত : ২৩০ হি.) বরিত ইমাম মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবেত্তা। হাফেজ যাহাবী লিখেছেন-‘সুফিয়ান ইবনে ওয়াইনা, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ এবং মুহাম্মদ ইবনে আমর আল-ওয়াকেদীর ছাত্র। ছিলেন ইলমের আকর। তাঁর তাবাকাত যে পাঠ করবে তাঁর ইলমের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হবে। বিশালায়তন এই গ্রন্থটির প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড-ব্যাপী পত্রস্থ হয়েছে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত। সর্বকালের সীরাত-পাঠক লেখক ও গবেষকদের কাছে এর গুরুত্ব অসামান্য!

পাঁচ. শামায়েলে তিরমিযী। গ্রন্থের মূল নাম : আশ-শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ। সংকলক ইমাম তিরমিযী রহ. (ওফাত : ২৭৯ হি.)। প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপরূপ দেহবল্লরির রূপম বর্ণনা, তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুরীর প্রেমময় বিবরণ এবং তাঁর ব্যক্তিজীবনের সুরভিত বাক্যান্যাস-বিশ্বময় নবীপ্রেমিকগণের আত্মার প্রসাদ! জানি না, এই গ্রন্থটিই সর্বাধিক পাঠ্য সীরাতগ্রন্থ কি-না। পৃথিবীর সভ্য কত ভাষায় এর অনুবাদ ও ভাষ্য রচিত হয়েছে ভক্তজনদের ভাষা-কুসুমে-সেও কেবল বলতে পারেন কাবার মালিক!

ছয়. আশ-শিফা বি তারীফি হুকুকিল মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শিফা নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। লেখক জগদ্বিখ্যাত আশেকে রাসূল কাজী ইয়াজ রহ. (ওফাত : ৫৪৪ হি.)।

পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবীর আলোচনা, তাঁর দেহ সৌন্দর্য, চারিত্রিক নির্মলতা, গুণাবলির উচ্চতা, আল্লাহর দরবারে তাঁর অনুপম সম্মান, শানে শাফায়াত, বিপুল মুজেযার বিবরণ, তাঁর প্রতি ঈমান এবং তাঁকে ভালোবাসার মোহন আদেশ ও বারণ আদর্শের সুবাসিত আবেগঘন নিটোল সরল বর্ণনা আর সবশেষে নবীজির পবিত্র জীবনসত্তা চরিত্র ও মিশনবিরোধী পাপী-পামরদের প্রতি কঠোর খেদ ও ক্ষোভের ভেতর দিয়ে রচিত হয়েছে গ্রন্থের ইতি! দুই খণ্ড-এক ভলিয়মে পাঁচশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থখানি গবেষক পাঠক ভক্ত সকলের কাছে সমান সমাদৃত।

গ্রন্থের মূল্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লেখকের মূল্য বড় কথা। কাজী ইয়াজ রহ. বরিত মুহাদ্দিস, তাফসীর ফেকাহ ও উসূলে মানিত পণ্ডিত। আরবী ভাষা ও আরব ইতিহাসের বড় বরেণ্য বিদ্বান! কবি, সাহিত্যিক, মালেকি মাজহাবের হাফেজ। এইসব গুণের বিকশিত ফসল তাঁর শেফা এবং ইকমালুল মুলিম ফী শরহি সহীহি মুসলিম।

সাত. ইবনুল আসীর রহ.-এর ইতিহাস-গ্রন্থ ‘আল-কামিল ফিত তারীখ’-ও সীরাত-গবেষক ও লেখকদের কাছে উৎসগ্রন্থরূপে বিবেচিত। ইবনুল আসীর-এর পুরো নাম ইযযুদ্দীন আবুল হাসান আলজাযারী আলমুসেলী (ওফাত :৬৩০ হি.)। সৃষ্টির সূচনা থেকে ৬২৮ হিজরী সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সমাজ রাষ্ট্র যুদ্ধ ও শাসনের ইতিহাস স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। বারো খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ঘটনাবলি পত্রস্থ হয়েছে সন-তারিখসহ। প্রতি বছরের ঘটনাবলি আলাদা। তাছাড়া ইবনুল আসীর কেবল প্রাপ্ত ঘটনাবলির সংকলক নন, তিনি ছিলেন ধীমান ঐতিহাসিক। ঘটনাগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রহণ বিন্যাস ও বর্জনে গভীরদৃষ্টি পর্যবেক্ষক ও শাস্ত্রজ্ঞ সমালোচকের পাথরে যাচাই করেছেন। লিখেছেন সাদামাটা গদ্যে। ইতিহাসের ধারা বেয়ে উঠে এসেছে ইসলামের অভ্যুদয় এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবীস্মরণীয় অধ্যায়ও।

আট. সীরাতের প্রাচীন ও সাদরে সমাদৃত উৎসগ্রন্থের মধ্যে আছে ‘উয়ুনুল আসার’। পুরো নাম : উয়ুনুল আসার ফী ফুনুনিল মাগাযী ওয়াশ শামাইল ওয়াস সিয়ার। লেখক : মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল ইয়ামুরী রহ. (ওফাত : ৭৩৪ হি.) প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ গভীরদৃষ্টি ফকীহ এবং হাফেজে হাদীস। হাদীস ও ফিকাহ উভয়শাস্ত্রে বরিত পণ্ডিত বলে পরবর্তীকালের গবেষকগণ তাঁর এই গ্রন্থকে অসামান্য আস্থায় বরণ করেছেন। হাফেজ ইবনে কাসীর রহ. তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন-‘হাদীসের টেক্সট ও সনদের মুখস্থ ভাণ্ডার, হাদীসের পরখশক্তি, ফেকাহ, যুদ্ধ-জিহাদ, কবিতা ও ইতিহাসের সামগ্রিক জ্ঞানবিচারে তাঁর কালে মিশরে তাঁর মতো কেউ ছিল না। অবশ্য সাধারণভাবে লেখকগণ তাঁকে শুধু ‘ইবনে সায়্যিদুন নাস’ নামেই উল্লেখ করে থাকেন।

নয়. হাফেজ যাহাবী রহ. আমাদের চরিতশাস্ত্রের বিশ্বস্ত শরণঘর। ইতিহাসের বিরল রত্ন এই মনীষী সম্পর্কে হাফেজ সুয়ুতী রহ. লিখেছেন-‘তিনি ছিলেন তাঁর কালের মুহাদ্দিস, খাতিমাতুল হুফফাজ-হাদীসশাস্ত্রের শেষ হাফেজ, ইসলামের ইতিহাসবেত্তা এবং শাস্ত্রের সমূহ ভাণ্ডারের অধিকারী।’ শাস্ত্রবিশারদগণের মতে-‘এখন জগতের মুহাদ্দিসগণ চরিত ও হাদীসের অন্যান্য বিষয়ে চার ব্যক্তির পুষ্যতুল্য। তাঁরা হলেন-হাফেজ মিযযী, যাহাবী, ইরাকী ও ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। ভাবা যায়, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানীর মতো ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুরু বলেছেন, ‘আমি এই নিয়তে যমযম পান করেছি-যেন স্মরণশক্তিতে যাহাবীর স্তরে পৌঁছতে পারি।’

হাদীস ও চরিত শাস্ত্রের এই অবিসংবাদিত ইমাম যখন রচনা করবেন হৃদয়ের বাদশাহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মোহন মনিব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কোনো গ্রন্থ-তখন তা কতটা শুদ্ধ সুন্দর ও উপভোগ্য হবে-ভেঙে বলতে হয় না। তৃপ্তির কথা, হাফেজ যাহাবী রহ. এই কাজটা করেছেন অশেষ যত্নে। দুই খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর এই সীরাত-গ্রন্থটির নাম ‘আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’। পরে লেখক এটাকে তাঁর জগদ্বিখ্যাত চরিতগ্রন্থ ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’র অংশ হিসাবেও প্রকাশ করেছেন। আধুনিক সংস্করণের প্রথম খণ্ড এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৫২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত-সবটাই সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পবিত্র কুরআনের নূর, ছত্রে ছত্রে হাদীসের অতুলপুষ্প উদ্ধৃতি আর শ্রদ্ধাবনত বিচার-বিশ্লেষণের মদিরায় সত্যিই এ এক অতুল অমৃত।

দশ. এই সোনালি কাফেলার আরেক স্বর্ণপুরুষ হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর রহ. (ওফাত : ৭৭৪ হি.)। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্র হাফেজ মিযযী রহ. এবং হাফেজ যাহাবী রহ.-এর। তাঁর সম্পর্কে হাফেজ যাহাবী বলেছেন-‘ইবনে কাসীর ইমাম মুফতী শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস দক্ষ ফকীহ ও মুফাসসির…। চরিত হাদীসের মতন টেক্সট ও ফেকাহ বিষয়ে গভীর মনোযোগী। তাখরীজ বিতর্ক তাফসীর ও লেখালেখিতে নিমগ্ন।’ আল্লামা আইনী রহ. বলেছেন, ‘উলামা ও হুফফাজে হাদীসের পথিকৃৎ। হাদীস শুনেছেন, সংকলন করেছেন, পাঠদান করেছেন, লিখেছেন। হাদীস তাফসীর ও ইতিহাস বিষয়ে ছিল তাঁর বিশাল পাণ্ডিত্য। ইতিহাস হাদীস ও তাফসীর তাঁর কাছে এসে পূর্ণতা পেয়েছে।’

প্রিয়তম নবী মুহাম্ম্দ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক. ‘ফুসুল ফী ইখতিসারি সীরাতির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’ দুই. ‘আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ।’

প্রথমটি সংক্ষিপ্ত। পরেরটি বিস্তৃত। এই বড় ও বিস্তৃত গ্রন্থটি তাঁর বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’র অংশ হিসেবে প্রকাশিত। আমরা সাধারণ গবেষকগণের লেখায় ‘বিদায়া’ নামে এই গ্রন্থেরই বিপুল উদ্ধৃতি লক্ষ করি।

এগার. আমরা জানি-প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি হন সত্য সুন্দও ও আলোর বৃক্ষ-সেই বৃক্ষের ফল ও ফুল হচ্ছে, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম। তাই তাঁকে জানতে হলে তাঁর জীবনের সুবাসিত ভাঁজে প্রবেশ করতে হলে তাঁদেরকেও জানতে হয় অবশ্যিকভাবে। এ ক্ষেত্রে ইবনুল আসীর রহ. (৬৩০ হি.)-এর ‘উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা’, হাফেজ যাহাবী রহ.-এর ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ এবং আমাদের আকাশের নক্ষত্র হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.)-এর ‘আল-ইসাবা ফী মারিফাতিস সাহাবা’ সবিশেষ পাঠ্য।

প্রিয়তম নবী মুহাম্ম্দ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানবার জন্যে এসব হলো উম্মাহর বিশাল ইতিহাসে মানিত ইমামগণের রচনা। পরবর্তীকালে যাঁরা নবীজির নামে মোম জ্বালাতে চেয়েছেন, আলো নিয়েছেন এইসব আলোকধার থেকেই। তাছাড়া তাঁরা সকলেই ছিলেন কুরআন হাদীস ও ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞানের অথৈ সাগর। তাই ঈমানের দৃঢ়তা জ্ঞানের আস্থা শ্রদ্ধার নূর আর বর্ণনার সততায় তাঁদের তুলনা হয় না। নবীজিকে জানতে হলে তাঁরাই প্রথম এবং প্রধান পাঠ্য।

চার.
এটা এই উম্মাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ঈর্ষণীয় অর্জন-সীরাতুন্নবী তাদের সর্বকালের প্রিয় বিষয়। কী পারিবারিক বৈঠক, বন্ধুজনের আড্ডা, রাজনৈতিক সভা, কবিতার আসর, মসজিদের মিম্বর আর ধর্ম-মাহফিলÑসবখানেই উত্তম উপমায়, পরম আবেগে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই উম্মাহর যারা কলমের সখা হয়েছেন যুগে যুগে তাদের মধ্যে নবীজিকে লিখে ধন্য হতে চেয়েছেন, হয়েছেন এমন ভাগ্যবানের সংখ্যা বিপুল। সম্ভবত পৃথিবীর সভ্য কোনো ভাষা বঞ্চিত হয়নি সীরাতুন্নবীর পুষ্প-পরশ থেকে। এ আমাদের অহঙ্কার। এই অর্জন ও গৌরবে আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারে এমন কোনো জাতি নেই, সম্প্রদায় নেই। মুনাজাত করি, এই ধারা অব্যাহত থাকুক এই পৃথিবীর শেষ সন্ধ্যা পর্যন্ত।

এই ধারায় আমাদের কাছাকাছি সময়ে নির্ভরযোগ্য আলেমগণের সীরাতগ্রন্থের তালিকাও দীর্ঘ। নানা রুচির নানা স্বাদের কয়েকটি গ্রন্থের নাম করতে পারি এইভাবে-

এক. মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ. রচিত ৩ খণ্ডে ‘সীরাতুল মুস্তফা’।

দুই. সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ. লিখিত সীরাত বিষয়ক স্মারকবক্তৃতা ‘খুতবাতে মাদরাস’।

তিন. উর্দু সাহিত্যে স্বতন্ত্র গদ্যশৈলীর জনক মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী রহ. রচিত ‘আন-নাবিয়্যুল খাতাম’।

চার. মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ মিয়া লিখিত ‘সীরাতে মুবারাকা’।

পাঁচ. মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রহ. রচিত ‘আসসীরাতুন নাবায়্যিাহ’ এবং ‘নবীয়ে রহমত’।

ছয়. শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দা রহ. রচিত ‘আর-রাসুলুল মুয়াল্লিম’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

সাত. মাওলানা আশেকে এলাহী মিরাঠী রহ. লিখিত ‘সীরাতে মাহতাবে আরব’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আট. হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়্যব রহ. রচিত ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’।

নয়. মাওলানা আসলাম কাসেমী লিখিত ‘সীরাতে পাক’।

দশ. মাওলানা আসীর আদরবী লিখিত ‘গারে হেরা ছে গুমবাদ খাযরা তক’।

বলে রাখি-এই তালিকা শুধুই উদাহরণ! আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ ও মৌলিক সীরাতগ্রন্থ সংখ্যায় অবশ্যই গর্ব করার মতো। মানসম্মত সীরাতকর্মের ঘরও শূন্য নয়, বলা ভালো আমরা স্বপ্নের পথে হাঁটছি!

কীভাবে পড়বেন

এক.
বই কীভাবে পড়ব-তার আগে ভাবতে হবে- বই কীভাবে নির্বাচন করব। এই বিষয়ে যে কথাটি যত্নের সঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে, নবীজির জীবনীপাঠ পৃথিবীর আর দশজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও মনীষীর জীবনী পাঠের মতো না। তাঁর জীবনপাতার প্রতিটি বর্ণ হেদায়াত ও নির্দেশনার একেকটি দীপ। তাঁর জীবনই দ্বীন। দ্বীন ও ইসলামকে মানা যেমন জরুরি এবং গ্রহণ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে যেমন সর্তকতা আবশ্যক-সীরাতুন্নবী জানা বোঝা ও গ্রহণের বিষয়টিও অনুরূপ। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরীন রহ. এই বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-‘এই ইলমই দ্বীন। সুতরাং তোমরা লক্ষ্য রেখো-কার কাছ থেকে কী গ্রহণ করছ।’ তাই সীরাতের জ্ঞানভাণ্ডার সীরাতগ্রন্থ নির্বাচনের সময় দেখতে হবে এর রচয়িতা-
এক. সাহাবায়ে কেরামের মতো সরাসরি উসতাদের কাছে কুরআন-হাদীস পড়েছেন কি না।

দুই. তিনি কুরআন-সুন্নাহর গভীরজ্ঞান-ফিকহের অধিকারী কি না।

তিন. পূর্বসুরিগণের চর্চিত ইলম ও গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কি না।

চার. আকীদা-বিশ্বাসে দলছুট গবেষক, না উম্মতের মূল কাফেলার সঙ্গে যুক্ত। সহজ কথায়-চতুর্থ শতাব্দীর পরের আলেম হলে চার মাযহাবের কোনো এক মাযহাবের অনুসারী কি না।

পাঁচ. তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অব্যর্থ শাশ্বত কমপ্লিট আদর্শ মনে করেন কি না। না অন্য কোনো দর্শনে বিশ্বাসী। সেই দর্শনের সঙ্গে সীরাতুন্নবীর কোনো ঘটনা আদেশ দর্শন সাংঘর্ষিক হলে সীরাতুন্নবীকে কাটছাট করে তার মানিত বিশ্বাসের অনুকূল করে নেবে।

ছয়. নবীজি ও তাঁর আদর্শের প্রতি এর ভক্তি শ্রদ্ধা ও অবিভাজ্য ভালোবাসা আছে কি না! কারণ-প্রেমিকের কাছে প্রেমাষ্পদের একটি ‘তিল’-ও সাত রাজার ধনের চাইতে অধিক প্রার্থনীয়।

সাত. চিন্তায় তিনি মধ্যপন্থী, না প্রান্তিকতার শিকার।

বই নির্বাচনের সময় এইসব বিষয় বিবেচনায় রাখা অতীব জরুরী। নইলে আমার নবীর ভালোবাসার কথা বলে আমাকে নিয়ে যেতে পারে মুমিন কাফেলার বাইরে অন্য কোথাও!

দুই.
পড়ার সময় আরেকটা কথা মাথায় রাখতে হবে-হাদীস ও সীরাতের মধ্যে সামান্য ব্যবধান আছে। যথা-
এক. মুহাদ্দিসগণের মুখ্যবিষয় শরীয়তের বিধিবিধান। প্রসঙ্গত আলোচনা করেন প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তা ও ব্যক্তি সম্পর্কেও। অথচ সীরাতকারদের মুখ্যবিষয় প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানা। ইসলামের নানা আাইন ও বিধানের কথা আলোচিত হয় প্রসঙ্গক্রমে।
তাই মুহাদ্দিসগণ সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করেনÑআসলেই কি এই কথা কিংবা কাজটা নবীজির? পক্ষান্তরে সীরাতকারগণকে এই সূত্র আবিষ্কারের পাশাপাশি আরও দুটি কাজ করতে হয়। যথাÑ
ক. নবীজি এই কাজটা কবে করেছেন, কথাটা কখন বলেছেন।
খ. এই কথাটা বলার কিংবা এই কাজটা করার রহস্যটা কী।
দুই. সীরাত-গবেষকগণ হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্মসমূহকে পরস্পর যুক্ত ও ধারাবাহিক ক্রমানুসারে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। তার কারণ ও রহস্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যথাসাধ্য। পক্ষান্তরে মুহাদ্দিসগণের কথা হলো, এটা নবীজির কর্ম কিংবা বাণী-এতটুকু প্রমাণিত হওয়াই যথেষ্ট। এতটুকু প্রমাণিত হলেই সেটা তাঁর সুন্নত ও পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কখন বলেছেন, করেছেন-তার দিন-তারিখ ও আগপর পরস্পর জানার কোনো প্রয়োজন নাই।
লক্ষ্যগত এই পার্থক্যের কারণে বিচারের মাণদণ্ডও আলাদা হয়ে গেছে। মুহাদ্দিসগণ রাবীর বিশ্বস্ততা সততা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে গ্রহণ-বর্জন নির্ণয় করন। দৃশ্যত মতভিন্নতা দেখা দিলে মীমাংসা করেন এইসব গুণের ভিত্তিতে। পক্ষান্তরে সীরাতগবেষকগণ বিচার করেন অবস্থার মিল ও ঘটনাবলির ইলম ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে।
সীরাত অধ্যায়নে শাস্ত্রবিদদের এইসব মূলনীতি মাথায় রাখলে পথ চলতে সহজ হয়।

তিন.
সীরাত পাঠে যাঁরা প্রবীণ, কিংবা যারা যথারীতি আলেম-তাঁরা পথ দেখাবেন অন্যদের। যাঁরা শিক্ষার্থী এবং নবীন-তাঁদের উদ্দেশে বলি! সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলো পবিত্র ইসলামের মানচিত্রের মতো। মানচিত্রটা নখদর্পণে থাকলে যেমন ভূগোল-ইতিহাস আয়ত্ব করা সহজ হয়; ইতিহাসটা মনে হয় দেখা-সত্য-সীরাতুন্নবী ভালোভাবে জানা থাকলেও ইসলামের যে-কোনো বিষয় মনে হয় সহজ। স্মৃতিতে দেখা-বিষয়ের মতো আঁকা হয়ে যায়। তাই ভালো হয়-

এক. প্রথমে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনবৃত্তান্তমূলক সংক্ষিপ্ত নির্ভরযোগ্য কোনো একটি বই অনেকবার পড়া। এই যেমন-
ক. ইমাম নববী লিখিত ‘তাহযীবুস সীরাতিন নাবাবিয়্যাহ’।
খ. মাওলানা সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ. লিখিত ‘রহমতে আলম’।
গ. মাওলানা হিফযুর রহমান সিওহারবী রচিত ‘নূরুল বাসার ফী সীরাতি সায়্যিদিল বাশার’ কিংবা
ঘ. মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. লিখিত ‘সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা এই জাতীয় সরল সংক্ষিপ্ত কোনো বই পড়া যেতে পারে।

দুই. পুরো বই কয়েকবার পড়তে হবে। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের ভাষায় -‘আইল বেঁধে’ পড়তে হবে। গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষভাবে মনে রাখবার জায়গাগুলো দাগ কেটে পড়তে হবে। এতে করে গ্রন্থের একটা ছবি মাথায় আঁকা হয়ে যাবে।

তিন. ডায়েরিতে নোট করে অবসর সময়ে, ওই নোট মনোযোগসহ পড়তে হবে। ভালো হয়, ডায়েরির নোটটা যেন-
ক. খুব পরিস্কার হরফে লেখা হয়।
খ. এক পাশে অর্ধেক পৃষ্ঠা ছেড়ে লেখা হয়।
গ. শিরোনাম ও তথ্য যদি আলাদা কালিতে লেখা হয়।
ঘ. সীরাত গ্রন্থের পৃষ্ঠা নম্বর লেখতে হবে অবশ্যই।
ঙ. পরে বড় ও বিশদ বর্ণনা বিশ্লেষণধর্মী সীরাতগ্রন্থ পড়ার সময় এই নোটটা সঙ্গে থাকবে এবং খালি অংশে নতুন তথ্য তথ্যের ভিন্নতা গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা-নম্বরসহ লিখে রাখবে।
মনে করি, এভাবে নোট করে দু-চারটা বই পড়লে হাদীস তাফসীর ফেকাহসহ ইসলামের যে-কোনো কিছু পড়ার সময় এক অনির্বাচনীয় স্বাদ ও তৃপ্তি অনুভূত হবে। ইসলামের সব কিছুকেই মনে হবে ঘরের কথা।

সীরাতুন্নবী আমাদের ভালোবাসার শৈল্পিক শিরোনাম। সীরাতুন্নবীর অমৃত ঝর্ণাধারায় সজীব আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের জীবন ‘জীবন’ হয় এই জীবন-মৃতের পেয়ালা পানে। কী ঘর কী সমাজ আর কী দেশ-সবখানেই আমরা শান্তি খুঁজি এই জীবনবৃক্ষের ছায়ায়। সীরাতুন্নবীর প্রতিটি বর্ণ আমাদের পথের দীপক দীপ, প্রাণের প্রশান্তি আর চলার পাথেয়। স্বপ্ন সাহস ও সফলতার শাশ্বত এই পাঠশালায় আমরা বারবার ফিরে আসি মনের টানে, জীবনের প্রয়োজনে। অসীম ভক্তি শ্রদ্ধা ও প্রেমে সমর্পিত হই চিরন্তন এই সিরাজাম মুনীরায়। দেড় হাজার বছরের দীঘল ইতিহাসে মলিন হতে দিইনি আমরা এই আলোকগ্রন্থের একটি বর্ণ। পার্থিব অপার্থিব সুখ সফলতা প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের অব্যর্থ মন্ত্রণা খুঁজি আমরা এইখানে। সীরাতুন্নবী আমাদের পথ। সীরাতুন্নবী পথ ও পাথেয় হোক পৃথিবীর সকল মানুষের-এই মুনাজাত করি।

মাওলানা মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন
বরেণ্য লেখক, বহু গ্রন্থ-প্রণেতা ও উস্তাযুল হাদিস

লেখাটি সৃজনঘর তারুণ্যের মাহফিল ২০২১ এর স্মারক-এ প্রকাশিত।

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!