রবীন্দ্রবাদ ও বাংলার সেকুলার সমাজ : সামাজিক পর্যবেক্ষণ

এডভোকেট মাওলানা নাইম হাসান ||

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও একজন গভীর রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন, তবে তিনি রবীন্দ্রবাদী ছিলেন না। ‘রবীন্দ্রবাদ’ হচ্ছে একটা কালচারাল প্রজেক্ট। সদ্য প্রয়াত মিতা হকরা যে চিন্তা লালন করতেন, হিজাব ও বোরখাকে বাঙ্গালিত্ব হতে খারিজ করেন এবং বাঙ্গালীত্ব ও বাঙ্গালী মুসলিম সংস্কৃতির মাঝে বাইনারি দাড় করান, এটাকেই রবীন্দ্রবাদী কালচারাল প্রজেক্ট বলে।

হিজাব ও পর্দা হাজার বছর ধরে বাঙ্গালী মুসলিমদের যাপিত জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়েও যে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারে না, সংস্কৃতির সে স্বেচ্ছাচারী ব্যাখ্যাকেই প্রত্যাখ্যান করুন। সংস্কৃতি হতে ধর্ম কে সম্পূর্ণ খারিজ করে বাঙ্গালী সংস্কৃতির যে কল্পিত রূপ বিনির্মানের চেষ্টা করা হয়েছে, তা সংস্কৃতির একাডেমিক সংজ্ঞা মতেও ভুল। শুধু ভুল নয়, ঘোরতর ভন্ডামি। সংস্কৃতির ক্লাসিকাল সংজ্ঞা মতে মানুষের চিন্তা, দর্শন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এগুলোই সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব কিছুকেই ধর্ম মৌলিক ভাবে বদলে দেয়। তাহলে ধর্মকে আপনি কি করে সংস্কৃতি হতে খারিজ করবেন..?

সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানগুলো বাদ দিয়ে এদেশের সংস্কৃতিজীবীরা কেবল পোশাক আশাক ও আচারিক রিচুয়ালকে সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করে। যা কেবল হাস্যকরই নয়, মূর্খতা ও বটে।এদেশের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র সংস্কৃতির মগজায়ন এভাবেই হয়েছে। ফলে প্রজন্ম সংস্কৃতি বলতে নাচগানের কিছু প্রকরণকেই বুঝে থাকে। এই মগজায়ন থেকেই ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বৈতবিভাজন তৈরি হয়েছে।অধ্যাপক আব্দুররাজ্জাক ও আহমদ সফারা এসব ভন্ডামি নিয়ে সতর্ক করে গেছেন।

সংস্কৃতি কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হয় না, বরং ধর্মই সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উপদান ও প্রভাবক। ধর্মই সংস্কৃতির প্রধান বিনির্মাতা। সংস্কৃতি ধর্মের অনুগামী হয়, এটাই ইতিহাসের অকাট্য বাস্তবতা। বর্তমান ইরানের হাজার বছরের পার্সিয়ান সংস্কৃতি ছিল, ইসলাম সেটিকে মৌলিক ভাবে বদলে দেয়। পার্সিয়ান ঐতিহ্য ও ইসলামের মিশেলে ইরানের সংস্কৃতি একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে, যেখানে ইসলামই প্রবল ছিল। ইসলাম ভারতে আসার পর ভারতীয় ঐতিহ্য ও ইসলামের মিশেলে যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সেটিই ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি।

দক্ষিণ ভারত হতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন বংশের আগমন না হলে আমরা যেটাকে সার্বজনীন বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে চালাতে চাই তার রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। ইন্টারেস্টিংলি, এদেশের কালচারাল এলিটরা সেই সনাতন সংস্কৃতিকেই বাঙ্গালীর সার্বজনীন সংস্কৃতি বলে প্রচার, আর ইসলাম কে হাজির করে আরবিয় আগ্রাসন বলে।

একই অঞ্চলে বসবাস করা দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অনেক কমন বা শেয়ার্ড উপাদান থাকে, তার মানে এই না যে উভয়ের সংস্কৃতি সেইম। বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলিম জীবনাচারে যে অজস্র পার্থক্য রয়েছে তার সিংহভাগই সাংস্কৃতিক পার্থক্য। এই পার্থক্য সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং আমাদের সহনশীল ও সুন্দর বৈচিত্র্য। বাঙ্গালী মুসলিম ও বাঙ্গালী হিন্দু উভয় জনগোষ্ঠী অনেক প্লুরালিস্ট এবং সহনশীল। এই সহনশীলতাই আমাদের যৌথ সংস্কৃতি। সার্বজনীন বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে ব্রাহ্মণবাদী আরোপনের বিরোধিতাই আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই। আমি একজন রবীন্দ্র অনুরাগী, তবে রবীন্দ্রবাদ বিরোধী।

লেখক :  আলেম, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

বিস্তারিত পড়ুন
Back to top button
error: Content is protected !!