স্ত্রীর সাথে মিথ্যা বলার সীমা: কিছু জরুরি বিবেচনা

যে হাদিসে বউয়ের কাছে জামাইয়ের ‘সত্য লুকানো’রে জায়েজ বলা হইছে, একই হাদিসে বউরেও জামাইয়ের কাছে সত্য লুকানোর এখতিয়ার দেওয়া হইছে। হাদিসের লফয এমন যে, জামাই-বউ পরস্পররে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা বলতে পারবে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, হাদিসে যে মিথ্যার কথা বলা হইছে, সেই মিথ্যার ক্ষেত্রে বউ ও জামাই মুশতারাক— সমান। এখন যদি ধরি যে, জামাই দ্বিতীয় বিয়ার ব্যাপারে বউরে মিথ্যা বলতে পারবে, তাইলে বউও কি সেটা পারবে? পারবে না, কারণ বউয়ের তো দ্বিতীয় বিয়ার এখতিয়ারই নাই, আর পরকীয়ার এখতিয়ার তো কারুরই নাই। বোঝা গেল, হাদিসে বর্ণিত ‘মিথ্যা বলা’ দ্বারা এমন মিথ্যা উদ্দেশ্য, যা বউ জামাইরে বা জামাই বউরে বলতে পারে। শুধু জামাই বউরে বলতে পারে, বা বলা লাগে— এরকম একপাক্ষিক মিথ্যা কি এই হাদিসের উদ্দেশ্য? জামাই বউরে না জানাইয়া বিদেশে আরেকটা বিয়া করবে, আর মিথ্যা বলবে— এই হাদিসের অর্থ কী এমন? ‘বউ/জামাইরে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা বলা’র সীমা কতটুক?

বউ/জামাইয়ের খুশির জন্য সত্য লুকানোর ব্যাখ্যা মুহাদ্দিসগণ হাদিসের কিতাবে দিছেন। এ ধরনের মিথ্যা কেমন হয়, হওয়া উচিত— সেগুলাও তারা উদাহরণসহ বয়ান করছেন।

সহিহ বুখারির সর্বজনগ্রাহ্য শরাহ ‘ফাতহুল বারি’। এই কিতাবে ‘সন্ধির অধ্যায়’র ‘باب ليس الكاذب الذي يصلح بين الناس’-পরিচ্ছেদে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. স্পষ্টভাষায় লিখছেন: ‘উলামারা একমত যে, জামাই বা বউরে মিথ্যা বলা (জায়েজ) তখনই, যদি এই মিথ্যা বলার কারণে জামাই বা বউয়ের কোন হক নষ্ট না হয়।’

ইমাম নববি রহ. তার ‘শরহে মুসলিম’-এ লিখেছেন: ‘জামাই/বউ একে অপররে মিথ্যা বলা, এর অর্থ হইল: অতিরিক্ত ভালবাসা দেখানোর জন্য (মিথ্যা বলা), বা এমন কিছুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া যা পূরণ করা জরুরি না। কিন্তু একের উপর অন্যের হকরে নাকচ করা বা নাহকভাবে কোন জিনিশ গ্রহণ করার জন্য ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেওয়া— এইটা মুসলিমদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।’ (১৬/১৫৮)

ইমাম বাগাভি রহ. ‘শরহুস সুন্নাহ’য় এই ‘মিথ্যা’র ব্যাপারে লিখছেন এবং বেশ সুন্দর একটা উদাহরণও দিছেন: ‘বউরে মিথ্যা বলার অর্থ হইল, তারে (ভাঙলে কোন ক্ষতি নাই এমন) ওয়াদা দেওয়া, সে খুউব আকাঙ্ক্ষিত— এমন ভাবমারা কথাবার্তা বলা, অতিরিক্ত প্রেম-ভালবাসা দেখানো…কথিত আছে যে, হযরত উমরের আমলে এক লোক তার বউরে বলল: আল্লাহর দোহাই দিয়া জিগেশ করলাম, আমারে ভালবাসো? বউ বলল: যদি আল্লাহর দোহাই দিয়া বলতে বলেন, তাইলে উত্তর হইল— বাসি না। ওই লোক তখন হযরত উমরের কাছে আসল। হযরত উমর তার বউরে ডাইকা আনলেন। বললেন: তুমিই কি সেই নারী, যে জামাইরে বলে— আপনারে ভালবাসি না? মহিলা বলল: আমিরুল মুমিনিন, উনি আল্লাহর নামে কসম খাইতে বলছিলেন, এখন আমি কি মিথ্যা বলব? উমর বললেন: অবশ্যই মিথ্যা বলবা। সব ঘরে তো আর প্রেম থাকে না। কিন্তু মানুশের উচিত ইসলাম ও নিয়ম-কানুন মোতাবেক জীবনযাপন করা।’ (১৩/১১৯)

শায়েখ সালেহ ইবনে উসাইমিন রহ. আরবের একজন বড় আলেম। বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ ‘রিয়াদুস সালেহিন’র ব্যাখ্যা লিখছেন উনি। সেখানে বউরে মিথ্যা বলার উদাহরণ দিতে গিয়া উনি লিখছেন: ‘তেমনিভাবে, জামাই/বউ একে অপররে মিথ্যা বলতে পারেন, যে মিথ্যায় প্রেম বাড়ে, মহব্বত বাড়ে। যেমন, বউরে বললেন: ‘তুমি অমূল্য’, ‘দুনিয়ার সকল নারীর চাইতে তোমারে আমি বেশি ভালবাসি’ ইত্যাদি।’ (১/১৭৯০)

তো, বউ/জামাইরে মিথ্যা বলার মানে হইল, যে মিথ্যায় কারো কোন হার্ম নাই, কারুর কোন হক নষ্ট হওয়ার ব্যাপার নাই, যে মিথ্যায় ভালবাসা বাড়ে, মহব্বত পয়দা হয়— সেইরকম মিথ্যা। বস্তুত, এগুলা মিথ্যাও না, এগুলা হইল এক ধরনের রেটরিকাল স্পিচ। আরেকটা ব্যাপার হইল, এই ধরনের মিথ্যায় কেবল বউরে/জামাইরে খুশি করাই হয় মূখ্য ব্যাপার, নিজের খাহেশাত না।

কেউ যদি ‘গোপনে’ প্রথম বউরে না জানাইয়া বিয়া করে বিবাহ হয়ে যাবে, তবে এইটা মাকরুহ হবে— হানাফি ও শাফেয়ি মাজহাবের এই মত। এরকম মত পোষণকারী ইন্ডিভিজুয়াল ফকিহদের মধ্যে আছেন: হযরত উমর, উতবা, নাফে, শা’বি প্রমুখ। অন্যদিকে মালেকি ও হাম্বলি ফকিহদের মতে, ‘এলান’ জরুরি। ঘোষণা দেওয়া ছাড়া বিয়া হবে না। ইন্ডিভিজুয়াল ফকিহদের মধ্যে এই মতের পক্ষে আছেন ইমাম যুহরি। এখন, ঘোষণার ক্রাইটেরিয়া কী? আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী। এর মধ্যে প্রথম বউ অবশ্যই গুরুতর পক্ষ।

এমনিতে প্রথম বউ বিয়ার সময় শর্ত দিলে তো আরেক বিয়ার আগে তার অনুমতি নেওয়াই লাগবে। কিন্তু শর্ত যদি নাও দ্যায়, তবু এই ধরনের গোপন বিয়ারে আলেমরা ‘মাকরুহ’ বলছেন, কারণ এইটার সাথে খুব গুরুতর কিছু হকের প্রশ্ন জড়িত।

প্রথমত, আদল বা ইনসাফের প্রশ্ন। জামাইয়ের কয়জন বউ, এইটা যদি কোন মেয়ে না জানে, তাইলে আদল বা ইনসাফ সে বুঝবে কীভাবে? যখন আপনি কোন ব্যাপারে দুই বা ততোধিক মানুশের মধ্যে ইনসাফ করতে চাইবেন, তখন এর প্রিকন্ডিশন হইল, ওই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের পূর্ণ অবগতি। যদি আপনার কোন এক বউ না জানে যে, আরো এক বা একাধিক বউ আপনার আছে, সেক্ষেত্রে গোড়ায়ই ওই বউয়ের সাথে ইনসাফ করা মুশকিল।
দ্বিতীয়ত, উত্তরাধিকার সম্পত্তি বিষয়ক ফাসাদের আশঙ্কা। এমনিতেই এ ধরনের ঝামেলা অহরহ হয়। এই ধরনের বিয়ায় তার সম্ভাবনা আরো বেশি। আর প্রথম বউ যদি পরের বউদের ব্যাপারে না জানে, এবং ওই অবস্থায়ই জামাই মারা যায়, সেক্ষেত্রে প্রথমজনসহ সকলের সাথেই বেইনসাফির বড় আশঙ্কা থাইকা যায়।

তৃতীয়ত, একাধিক বিয়ার জন্য ইসলামে কিছু ক্রাইটেরিয়া ও শর্ত তো আছেই। কিন্তু এর বাইরেও, ওলামায়ে কেরাম এই ব্যাপারে যে ফয়সালাগুলা দিছেন, সেগুলা লক্ষনীয়। অবিসংবাদিতভাবে হালাল কোন জিনিশ কেউ হারাম করতে পারে না— এইটা ইসলামি ফেকাহর কেন্দ্রীয় একটা মূলনীতি। ধরেন, আঙুর খাওয়া হালাল। আপনি কাউরে এই শর্ত দিয়া বিয়া করতে পারবেন না যে, বিয়ার পরে আঙুর খাওয়া যাবে না। আল্লাহর রাসুল একবার উনার বউদের সাথে গোসা কইরা এইরকম হালাল একটা জিনিশ নিজের জন্য হারাম কইরা নিছিলেন। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন: ‘হে নবি, আল্লাহ আপনার জন্য যে জিনিশ বৈধ করছেন, তারে অবৈধ বানাইতেছেন কেন?’ (তাহরিম, ১)

এখন, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দেখেন, প্রথম বউ আর বিয়া না করার শর্ত দিতে পারবেন। এবং সেই শর্ত না মানলে বউয়ের ওই বিবাহে না থাকার এখতিয়ার থাকবে। তার মানে, দ্বিতীয় বিয়া বা একাধিক বিয়া এমন এক হালাল কাজ, যার পক্ষ একটা না, একাধিক; কেবল কর্তা না, অন্য আরেকজন মানুশও ওই কাজের ফলাফলের সাথে জড়িত, আর তাই ওই কাজের ব্যাপারে তার প্রশ্ন তোলার বা ভেটো দেওয়ার অধিকার আছে। কারণ একটা বিয়া শুধুমাত্র যৌনতার প্রশ্ন না, অনেকগুলা হক ও অধিকারেরও প্রশ্ন। ফলে, এই হালাল কাজেও ভেটো দিতে পারবে প্রথম বউ। একাধিক বিয়া এমন এক বস্তু, যার পক্ষ একাধিক এবং ইসলামি আইনের এসেন্স হইল, এই দুইপক্ষের অধিকার আছে ব্যাপারটারে দুইভাবে নেওয়ার। সেজন্য জামাই একাধিক বিয়া করলে বউ যেকোন হালতে তা মানতে বাধ্য থাকবে, এরকম কোন নির্দেশনা কোরান-হাদিসে নাই। জামাইয়ের তরফে যেমন এইটা করা বৈধ, তেমন বউয়ের তরফে এর বিপক্ষে ভেটো দেওয়াও বৈধ। এইটা করাই হইছে এইজন্য যে, একাধিক বিয়া এমন এক জিনিশ, যার সাথে খাহেশাত খুব বিপজ্জনকভাবে জড়িত থাকে, এবং অন্যের হক নষ্টের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

ফলে, যে জিনিশে ভেটো দেওয়ার অধিকার বউয়ের আছে, তা যদি কেউ তারে না-ই জানায়, তাইলে তো ইনসাফ হয় না। আমি একটা সুরতে মাসালা বলি, কথাটা খোলাসা করার জন্য। ধরেন, সখিনা বাবলুরে বিয়ে করছে এই শর্তে যে, সে আর বিয়া করবে না। এখন বাবলু বিয়া করছে ঠিকই, কিন্তু সখিনারে জানায় নাই। এই বিয়া তো হয়েই যাবে। কিন্তু, সেক্ষেত্রে সখিনার ভেটো-পাওয়ারের কী হবে? সে তো জানেই না যে বাবলু আবার বিয়া করছে! আর যদি সখিনা বিয়ার আগে এরকম শর্ত নাও দেয়, তাও ইসলামি আইনের এসেন্স ধইরা আমরা বুঝতে পারি যে, এই ধরনের গোপনীয়তা কেবল দিয়ানতের খেলাফই না, বউ-সন্তানদের অনেক হক নষ্ট হওয়ারও প্রথম ধাপ।

মানে দাঁড়ায়, যেকোন বিয়াশাদির সাথেই অনেকগুলা হক সংশ্লিষ্ট থাকে; এবং দ্বিতীয় বিয়ার মধ্যে প্রথম বউয়েরও অনেকগুলা হক সংক্রান্ত বোঝাপড়া থাকে। ফলে, এই জিনিশ গোপন করলে, বিবাহ বৈধ হইলেও নানারকম ফেতনা-ফাসাদ ও হক নষ্ট হওয়ার পথ খুইলা যায়। ফলে, আলোচ্য হাদিসে এই ধরনের মিথ্যার কথা বলা হয় নাই, তা পষ্ট। মুহাদ্দিসদের উদাহরণগুলা বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যায়।

চলমান মামুনুল হক ইস্যুতে আমি কিছু লেখি নাই, লেখার ইচ্ছাও নাই। এই লেখাটাও মামুনুল হক সাহেবের বক্তব্যের কোন প্রতিবক্তব্য হিশাবে লেখা হয় নাই, আমার সে যোগ্যতা বিন্দুমাত্রও নাই। উনি ওনার বক্তব্যের দায় নেবেন, ব্যাখ্যা দেবেন, দুনিয়ায় ও আখেরাতে, সেই দায় অন্য কারুর না। কিন্তু, লেখাটা লিখলাম দুটি কারণে।

এক. ওনার এই বক্তব্যরে দলিল বানিয়ে, মুসলিম শরিফে বর্ণিত হযরত উম্মে কুলসুমের হাদিসটারে প্রমাণ হিশাবে উপস্থাপন করে, অনেকেই দাবি করতে চাইতেছেন যে— মামুনুল হক সাহেবের ওই বক্তব্য যে মানবে না, সে কাফের হয়ে যাবে, হাদিস অস্বীকারকারী মুলহিদ হয়ে যাবে ইত্যাদি। এটা কোন সঠিক কথা হইতে পারে না। মামুন সাহেবের যেকোন ব্যাখ্যার পক্ষে আপনি দাঁড়ান, সেইটা সময়ের দাবি। কিন্তু উনার প্রত্যেকটা বক্তব্যরে সাপোর্ট দেওয়া আর না দেওয়ার ভিত্তিতে লোকজনের দ্বীন-ঈমান ঠিক কইরা দিয়েন না। মামুন সাহেব শরিয়তের দলিল না। যেকোন হাদিসের ক্ষেত্রে উনার একটা মতামত থাকতে পারে, আরো দশজনের ভিন্ন মতামত থাকতে পারে।

দুই. মামুনুল হক সাহেব হয়ত প্রত্যেকের হক পুরাপুরি রক্ষা করতে পারছেন, উনার বউরাও কেউ উনার উপরে নারাজ না, ওনাদের ফ্যামিলির ভিতরে ব্যাপারগুলা সুষ্ঠুভাবে মীমাংসা হইছে। কিন্তু, যে কনটেক্সটে উনি বক্তব্যটা দিছেন, সেটা খুবই বিশেষ একটা কনটেক্সট বা পরিস্থিতি, এ ব্যাপারে সকলেই আশা করি একমত। বিশেষ কনটেক্সটে দেওয়া ওনার এই বক্তব্য বা ফতোয়া, কোনরকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়া আমভাবে সমাজের মানুশ ফলো করা শুরু করলে, পরিবারগুলোতে নানারকম সমস্যা দেখা দেবে, ফেতনা-ফাসাদ তৈরি হবে— বলাইবাহুল্য। ফলে, এই হাদিসের সম্ভাব্য হদ বা সীমা কী বা কেমন হতে পারে— তা নিয়া আলাপ জরুরি মনে করেই এই পোস্ট লেখা। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।

বিস্তারিত পড়ুন

সম্পর্কিত পোস্ট

Back to top button
error: Content is protected !!